দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৯ এপ্রিল: অপেক্ষায় ছিলেন সহকর্মীরা। আশায় বুক বেঁধেছিলেন প্রধান শিক্ষকরাও। তবে, সেই অশা পূরণ হলো না! স্কুলমুখো হলেন না পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চাকরিচ্যুত শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীরা! স্কুলে স্কুলে স্টাফ রুম ফাঁকা থাকলো মঙ্গলবারও। হাতেগোনা দু’একজন ছাড়া জেলায় চাকরি হারানো প্রায় ১৭০০ জন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে ৯৯ শতাংশই এদিন অনুপস্থিত থেকেছেন বলে জেলা শিক্ষা দপ্তরের একটি সূত্রে জানা গেছে। সেই তালিকায় যেমন আছেন যোগ্য শিক্ষকরা, ঠিক তেমনই অযোগ্য বা ‘টেন্টেড’ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরাও স্কুলের পথ মাড়াননি এদিন। দু’একজন তো ‘যাব’ আশ্বাস দিয়েও শেষ পর্যন্ত স্কুলে পৌঁছননি বলে প্রধান শিক্ষকরা জানিয়েছেন! খড়গপুর মহকুমার দাঁতনের নিমপুর বরঙ্গী হাইস্কুলের ৭ জন শিক্ষক ও ১ জন শিক্ষাকর্মী চাকরি হারিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অরূপ প্রধান জানান, “আমরা আশা করেছিলাম, হয়তো ওঁরা স্কুলে আসবেন। তবে, শেষ পর্যন্ত কেউই আসেননি! মাত্র ৮ জনে মিলে কোনোমতে পঞ্চম-দশম শ্রেণীর পরীক্ষা (ফার্স্ট সামেটিভ) নেওয়া হয়েছে। আগামীদিনে খাতা দেখা থেকে দ্বাদশ শ্রেণী অবধি ক্লাস চালানো, প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।” একই অবস্থা নারায়ণগড়ের শশিন্দা সাগরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়েও। চাকরি বাতিল হওয়া ৮ জন শিক্ষকই অনুপস্থিত ছিলেন এদিন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপঙ্কর তেওয়ারি জানান, “১৭ জন শিক্ষকের মধ্যে ৮ জনের চাকরি বাতিল হয়েছে। বায়ো সায়েন্স বিভাগ শিক্ষক-শূন্য। পিউর সায়েন্স আর বাংলাতে একজন করে শিক্ষক। স্কুল চলবে কিভাবে? অবিলম্বে শিক্ষা দপ্তর কিছু একটা করুক।”

সবং ব্লকের মোহাড় ব্রহ্মময়ী হাইস্কুলের ৬ জন শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন। তালিকায় আছেন পিংলা ব্লকের জলচক অঞ্চল তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অজয় মাজিও। ‘টেন্টেড’ (ওএমআর বিকৃত) তালিকায় নাম থাকা বাংলার শিক্ষক (নবম-দশম শ্রেণীর) মঙ্গলবার সকালে জানিয়েছিলেন ‘স্কুলে যাব’। শেষ পর্যন্ত অবশ্য স্কুলের চৌকাঠ মাড়াননি তিনি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুদীপ শাসমল বলেন, “৬ জন শিক্ষকই এদিন আসেননি স্কুলে।” মেদিনীপুর সদর মহকুমার পিংবনী হাইস্কুলে ৬ জন শিক্ষক ও ৩ জন শিক্ষাকর্মী চাকরি হারিয়েছেন। এছাড়াও, মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠ, গুড়গুড়িপাল উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁদড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকরি হারিয়েছেন গড়ে ৫-৬ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী। স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা মঙ্গলবার বিকেলে জানিয়েছেন, “একজন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীও স্কুলে আসেননি এদিন।” উপরের প্রতিটি স্কুলেই যোগ্য শিক্ষকদের সাথে ‘টেন্টেড’ বা অযোগ্য শিক্ষকরাও এক-দু’জন করে ছিলেন। তাঁরাও এদিন স্কুলে আসেননি! তারমধ্যেই ব্যতিক্রম গড়বেতার মোংলাপোতা হাইস্কুল ও শালবনীর কড়াইমুড়ি নেতাজি সুভাষ হাইস্কুল। মোংলাপোতার ৬ জন শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২ জন শিক্ষক মঙ্গলবার স্কুলে এসেছিলেন বলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রাজেশ সর্দার জানিয়েছেন। অনুপস্থিত শিক্ষকদের মধ্যে একজন জানিয়েছেন, “যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন নবম-দশম শ্রেণীর টেন্টেড (ওএমআর কারচুপির অভিযোগ আছে) তালিকায় আছেন!” কডলাইমুড়ি স্কুলের চাকরি হারানো ৩ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার মধ্যে একজন শিক্ষিকা স্কুলে এসেছিলেন বলে প্রধান শিক্ষক সুভাষ জানা জানিয়েছেন। ঘাটালের রথিপুর বরোদা বিদ্যাপীঠের শিক্ষক তথা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের জেলা মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক রামজীবন মাণ্ডি বলেন, “আমাদের স্কুলের ২ জন শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী আশ্বস্ত করার পর তাঁদের স্কুলে আসার আহ্বান জানিয়েছিলাম আমি। তাঁরা জানিয়েছেন, মানসিক অবস্থা ভালো নয়। দু’একদিন পর ভেবে দেখবেন!”
সোমবার যোগ্য শিক্ষকদের আশ্বাস দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে, সেই ‘মৌখিক’ আশ্বাসে সন্তুষ্ট হতে পারেননি চাকরি হারানো শিক্ষকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়েই ক্যামেরার সামনে তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের দাবি একটাই, “যোগ্য এবং অযোগ্যদের পৃথকভাবে ওএমআর (OMR) এবং তালিকা প্রকাশ করতে হবে ওয়েবসাইটে। আর যোগ্য শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের সেই লিস্ট নিয়েই সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন করতে হবে।” এই দাবিকে সামনে রেখেই মঙ্গলবার দুপুর থেকে জেলা শহর মেদিনীপুরে আন্দোলনে নেমেছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের কয়েকশ শিক্ষক, শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী। ডিআই অফিসে (শিক্ষা ভবনে) তালা ঝুলিয়ে হুঙ্কার দিয়েছিলেন, “সিভিক বা ভলেন্টিয়ার শিক্ষক নয়, আমরা সসম্মানে স্কুলে ফিরতে চাই।” স্লোগান ওঠে, “উই ওয়ান্ট সেগ্রিগেশন (পৃথকীকরণ)।” অবিলম্বে যোগ্য শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের ওএমআর এবং তালিকা স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ না করলে রাজ্যজুড়ে আন্দোলনের আগুন জ্বালানোর হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। জেলার যোগ্য শিক্ষকদের তরফে অলক জানা, কৃষ্ণগোপাল চক্রবর্তী, অভিজিৎ গিরি, উমা দাস, সঙ্গীতা সাহা প্রমুখ বলেন, “যোগ্য-অযোগ্যদের ওএমআর এবং তালিকা প্রকাশ করলেই দুধ আর জল আলাদা হয়ে যাবে। আর যোগ্যদের তালিকা নিয়েই সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন করতে হবে। সেইসঙ্গে যোগ্যদের যাতে সার্ভিস ব্রেক না হয়, সেই বিষয়টিও সুনিশ্চিত করতে হবে। আর কোনভাবেই কোনো স্কুলে চুক্তিভিত্তিক বা আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়োগ করা যাবে না।” তাঁদের আরও দাবি, “অযোগ্য শিক্ষকদের অবিলম্বে বরখাস্ত করতে হবে।” বিকেল চারটা নাগাদ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ডিআই স্বপন সামন্ত। তারপরই খোলা হয় ডিআই অফিসের মূল প্রবেশপথের তালা। ডিআই দাবিগুলি লিখিত আকারে জমা দেওয়ার কথা বলেন। চাকরিহারাদের তরফে দাবি করা হয়, তাঁদের দাবিগুলির প্রেক্ষিতে বুধবার সকালে ডিআই-র ‘পদক্ষেপ’ লিখিত ভাবেই জানাতে হবে। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের স্মারকলিপি গ্রহণ করেন ডিআই স্বপন সামন্ত। তিনি জানান, “শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের দাবির বিষয়গুলি আমি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।”