দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২১ ফেব্রুয়ারি: “ওর বয়সী ছেলেরা যখন বিকেল হলেই মোবাইল কিংবা বাজে আড্ডাতে ডুবে দেয়, সেই সময়টাকেই কিভাবে সংসারের প্রয়োজনে আর নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড়ে ব্যবহার করতে হয়; সেটা সন্দীপ দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা তো প্রায়ই অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে ওর উদাহরণ দিই। ওকে দৃষ্টান্ত হিসেবেও তুলে ধরি।” প্রিয় ছাত্র সম্পর্কে ঠিক এমনই উপলব্ধির কথা তুলে ধরেন পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন ভাগবতচরণ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক অরবিন্দ দাস। তাঁর কথায়, “সকলেই উচ্চ মেধা সম্পন্ন হয় না। সবাইকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, এমনটাও জরুরি নয়। কিন্তু, সকলে যদি মানুষের মতো মানুষ হয়, পরিশ্রমী-নিষ্ঠাবান হয়; তাহলেই বদলে যেতে পারে আমাদের এই সমাজটা!” ঠিক এই কারণেই যে দাঁতন ভাগবতচরণ হাই স্কুলের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র সন্দীপ দাস তাঁদের কাছে দৃষ্টান্ত স্বরূপ, তা একবাক্যে স্বীকার করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি জানান, দাঁতন এলাকারই বাসিন্দা সন্দীপ পঞ্চম শ্রেণী থেকেই তাঁদের স্কুলের ছাত্র। মাধ্যমিক পাস করার পর, সন্দীপ এখন একাদশ শ্রেণীতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছে। শুধু কি তাই? সংসারের হাল ধরতে আর নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে, সেই ১২ বছর বয়স থেকে দাঁতন বাজার সংলগ্ন কালীচন্ডী বাজারে ফুচকা বিক্রি করে সন্দীপ। স্কুল ছুটির পর বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি সন্দীপ ফুচকার দোকান চালায়। তারপর বাড়ি ফিরে টিউশন পড়তে যায় কিংবা বাড়িতে নিজেই মন দিয়ে পড়াশোনা করে। এভাবেই চলছে গত ৫ বছর ধরে। এমনটাই জানান সন্দীপের প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবরাও।

thebengalpost.net
সন্দীপ দাস:

thebengalpost.net
বিজ্ঞাপন (Advertisement):

প্রসঙ্গত, দাঁতনের বাসিন্দা পঞ্চানন দাস ও যমুনা দাসের দুই ছেলে- শুভদীপ ও সন্দীপ। এলাকাবাসীরা জানান, ছোট থেকেই দুই ছেলে যেমন ভদ্র, বিনয়ী; ঠিক তেমনই পরিশ্রমী। আর পড়াশোনাতেও ভালো। একটা সময় দিনমজুরি করে, রিক্সা চালিয়ে, ফুচকা দোকান করে সংসার চালিয়েছেন পঞ্চানন বাবু। পরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কঠোর পরিশ্রম করার শক্তি হারান! শেষমেশ বছর পাঁচেক আগে ভিনরাজ্যে একটি কারখানায় ছোটোখাটো একটি কাজ পেয়েছেন। যদিও, বেতন স্বল্প। তাঁর পাঠানো টাকায় কোনমতে সংসার চলে গেলেও, বিজ্ঞান শাখায় পাঠরত ছোট ছেলের টিউশনির টাকা জোগাড় করা মুশকিল! বড় ছেলে শুভদীপ এখন নিজের খরচ, নিজে চালিয়ে নেয়। আর, সন্দীপ? ছোট থেকেই সে বাবা, মা আর দাদাকে পরিশ্রম করতে দেখেছে। তাই, নিজের টিউশনির অর্থ জোগাড় করতে আর মা-কে একটু ভাল রাখতে, নিজের নরম কাঁধে, অনেক বড় দায়িত্ব তুলে নিয়েছে সন্দীপ! সন্দীপের মা যমুনা দাস জানান, “তখন ও ক্লাস সিক্সে বা সেভেনে পড়ে হয়তো। ১২-১৩ বছর বয়স। ওর দাদা, মানে আমাদের বড় ছেলে তখন সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। বাইরে কোথাও ভর্তি হবে। এদিকে সংসারের খরচ। সবকিছু চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন ওদের বাবা। কখনও রিক্সা চালিয়ে, কখনও ফুচকা দোকান করে রোজগার করার চেষ্টা করছেন। আর তা করতে গিয়েই মাঝেমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন! সেই সময়ই সন্দীপ একদিন ওর বাবা-কে বলে, ‘বাবা আমি তোমার ফুচকার দোকানটা চালাব?’ সেই থেকেই শুরু! এখন আমি ওকে ফুচকা তৈরি করে দিই। বিকেলে ও গিয়ে বিক্রি করে। ফিরে এসে, পড়াশোনা করে। যা রোজগার হয়, ওর টিউশনির খরচ, আমাদের সংসারের টুকটাক খরচ সবটাই মোটামুটি হয়ে যায়। জানি, এজন্য ওর পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে! অনেকে এজন্য বলেনও আমাকে, এত ছোট বয়স থেকে ফুচকা বিক্রি করছে? কিন্তু, কি আর করব। বাধ্য হয়েই তো…!”

কিছুক্ষণ থেমে যমুনা দেবী যোগ করেন, “আমাদের দুই ছেলেই ছোট থেকে কষ্ট করে বড় হচ্ছে। পরিশ্রম করতে ওরা কখনও পিছপা হয়নি। এখন তো নিজের পড়াশোনার সাথে সাথে সংসারের সবকিছু সন্দীপ-ই সামলায়। ওর দাদা আর বাবা বাইরে থাকেন। নিজেকে আমি এই বলে সান্ত্বনা দিই যে, ওর বয়সী অন্যান্য ছেলেরা যখন মোবাইল নিয়ে মেতে থাকে, বাজে আড্ডা দেয়; ও তখন সংসারের প্রয়োজনে আর নিজের টিউশনির খরচ তুলতে কঠোর পরিশ্রম করে। হোক না সে ফুচকা বিক্রি! পৃথিবীতে কোন কাজই তো ছোট নয়। আপনারা ওকে আশীর্বাদ করুন, ও যেন মানুষের মতো মানুষ হতে পারে। নিজের পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে!” লাজুক প্রকৃতির সন্দীপ অবশ্য বলে, “কি এমন করছি! সকালে টিউশন থাকে। তারপর বাজারে যাই। বাজার করে এনে দিই মা-কে। তারপর হয় স্কুল কিংবা আবার টিউশনি! মা এই সময়টাতে ফুচকা তৈরি থেকে শুরু করে সব কিছু রেডি করে রাখেন। আমি শুধু বিকেলে বাজারে গিয়ে বিক্রি করি। ফিরে এসে পড়াশোনা করি। মা-ই তো সবকিছু করেন!” মাধ্যমিকে আশানুরূপ রেজাল্ট হয়নি। এত কাজকর্মের পর, উচ্চ মাধ্যমিকে ফল ভাল হবে তো? সন্দীপ বলে, “হ্যাঁ, নানা কারণে মাধ্যমিকের ফল একটু খারাপ হয়েছে। কিছু নম্বরের জন্য ফার্স্ট ডিভিশন হয়নি। উচ্চ মাধ্যমিকে চেষ্টা করছি ভালো করার!” স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা খুব সাহায্য করেন বলে জানায় সন্দীপ। তবে, সন্দীপ কখনও মুখ ফুটে কোনও সাহায্য চায়নি বলে জানান প্রধান শিক্ষক অরবিন্দ দাস। তিনি বলেন, “দুই ভাইই খুব ভদ্র, নম্র ও বিনয়ী। পড়াশোনাতেও ভাল। কঠোর পরিশ্রমী। আমি সন্দীপকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, কিছু প্রয়োজন হলে জানাতে। কখনও কিচ্ছু চায়নি! তার চাইতে ও হয়তো নিজে পরিশ্রম করে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাই বেশি গর্বের বলে মনে করছে। এরকম ছেলেরাই তো আমাদের গর্ব!” দাঁতন ভাগবতচরণ হাই স্কুলের সহ শিক্ষক পুলক প্রধান, শঙ্কর চন্দ্র দোলই, সোমনাথ মাইতি-রা বলেন, “শ্রমের কোনও বিকল্প হয় না! যে ছেলে এমন পরিশ্রমী, ভদ্র, বিনয়ী হয়; তাকে রুখে দেয় কার সাধ্য!”

thebengalpost.net
নিজের দোকানে সন্দীপ:

thebengalpost.net
বিজ্ঞাপন (Advertisement):