দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৮ মার্চ: রূপসার বয়স তখন মাত্র দু’বছর। মিষ্টি মেয়েটির শরীরে বাসা বাঁধে এক বিরল স্নায়বিক রোগ। চিকিৎসা পরিভাষায় যার নাম ‘স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি’ বা এসএমএ (SMA/ Spinal Muscular Atrophy)। জেনেটিক ডিস-অর্ডারের ফলে এই বিরল রোগ হয়। শরীরে একবার বাসা বাঁধলে, সে কখনো উঠে দাঁড়াতে পারেনা। সারা জীবন শুয়ে-বসেই কাটাতে হয়। স্পাইনাল কর্ড বেঁকে গিয়ে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে প্রায় গোটা শরীর! পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা শহর মেদিনীপুরের বল্লভপুর এলাকার বাসিন্দা সৌমেন মুখার্জি ও সান্ত্বনা মুখার্জির একমাত্র মেয়ে রূপসার শরীরে এই বিরল রোগ ধরা পড়ে ২০১৭ সালে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মাথায় হঠাৎ করেই যেন বাজ ভেঙে পড়ে! এই রোগের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন কোটি টাকার বিদেশি ইঞ্জেকশন। পেশায় অলংকার দোকানের সামান্য কর্মচারী সৌমেন সেই টাকা পাবেন কোথায়? স্বাভাবিকভাবেই ছোট্ট রূপসা-কে নিয়ে এক অসম জীবন যুদ্ধে সামিল হন সৌমেন-সান্ত্বনা!

যে বয়সে অন্যান্য শিশুরা হেসে-খেলে-দৌড়ে বেড়ায়, সেই বয়স থেকেই রূপসার জীবন এগিয়ে চলেছে হুইল চেয়ারে! তবে, কোন কিছুই থামিয়ে রাখতে পারেনি রূপসাকে। রূপসা এখন স্থানীয় টাউন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। ক্লাসে প্রথম হয় সে। আবৃত্তিতেও প্রথম বা দ্বিতীয় ছাড়া কখনো হয় না। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রাথমিকের জেলা বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাতেও আবৃত্তিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে রূপসা। আর এই সবকিছুর নেপথ্যে মা সান্ত্বনা (সাথী)-র কঠোর পরিশ্রম, লড়াই। বাংলায় স্নাতকোত্তর সান্ত্বনা ওরফে সাথী আট বছর আগেই ভুলেছেন শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন! সারাদিন মেয়েকে নিয়েই থাকতে হয়। মেয়ের যত্ন, খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা থেকে নিয়ম করে ফিজিওথেরাপি করে দেওয়া- সবকিছু একা হাতে করতে হয় তাঁকে। স্বামী সৌমেন মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে নিজের কাজে চলে যান। বাড়িতে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন। তাঁদের জন্যও রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সবকিছু করতে হয়। হাসিমুখে সমস্ত কিছু সামলে মেয়ের আবৃত্তি, গান প্রভৃতির শখ পূরণ করতে হয়।
শনিবার, নারী দিবসের সকালে সৌমেন বলেন, “আমার কাছে আমার স্ত্রী সত্যিই নারী, মহীয়সী! বলুন তো, ও না থাকলে কি হত আমার রূপসার? কি হত আমাদের সংসারের। স্কুলে যখন অভীক স্যার, চিন্ময় স্যার-রা রূপসার প্রশংসা করে, আমি বলি সব কৃতিত্বই আমার স্ত্রী-র!” সৌমেন অবশ্য স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেনা, এই রূপসাকেই একদিন সহজে কোন স্কুল ভর্তি নিতে চায়নি! ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন ডিপিএসসি চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দু বিষই রূপসা-কে এই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। একটি হুইল চেয়ারও উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। এখন অনলাইনে আবৃত্তি, গান শেখে রূপসা। পাশে বসে থাকেন সান্ত্বনা। মেয়ের ইচ্ছেশক্তি দেখে মাঝেমধ্যে চোখে জল চলে আসে তাঁর! শনিবার, নারী দিবসের সকালে ধরা গলায়, চোখে জল নিয়ে সান্ত্বনা বলেন, “ও সহজেই রপ্ত করে ফেলে সবকিছু। ওর জন্যই তো নিজের সমস্ত স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে ওকে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করছি। বাকিটা ঈশ্বরের হাতে!”