দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম, ২৮ ফেব্রুয়ারি: মাও অধ্যুষিত জঙ্গলমহল একসময় কাঁপত তাঁদের নামে! ঝাড়গ্রামের শিলদার EFR ক্যাম্পে ভয়াবহ হামলায় অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত সেই বিকাশ (ওরফে মনসারাম হেমব্রম), তাঁর স্ত্রী তারা (ওরফে ঠাকুরমণি হেমব্রম) সহ ১৩ জনের যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করল মেদিনীপুর আদালত। মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) শিলদার (ঝাড়গ্রাম) EFR ক্যাম্পে মাও হামলার মামলায় চার্জশিটে নাম থাকা ২৪ জনের মধ্যে জীবিত ২৩ জনকেই (বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন মৃত্যু হয়েছিল ১ জনের) দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন মেদিনীপুর জেলা আদালতের অতিরিক্ত জেলা এবং দায়রা বিচারক সেলিম শাহী। আজ, বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) তাঁদের মধ্যে ১৩ জনের সাজা ঘোষণা করলেন বিচারক সেলিম শাহী। মোট ১৪টি ধারায় তাদের সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। একইসঙ্গে ১০ হাজার টাকা জরিমানা (অনাদায়ে আরও ৩ মাসের জেল)-ও করা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত এবং হেফাজতে থাকা বাকি ১০ জনের সাজা ঘোষণা করা হবে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার)।

thebengalpost.net
শিলদা কাণ্ডে সাজা ঘোষণা:

এদিন, যে ১৩ জনের সাজা ঘোষণা করা হল, তাঁরা হলেন যথাক্রমে- ১. মনসারাম হেমরম ওরফে বিকাশ ২. ঠাকুরমনি হেমব্রম ওরফে তারা ওরফে পাখি (বিকাশের স্ত্রী) ৩. কল্পনা মাইতি ওরফে অনু ওরফে রীনা ৪. মানস মাহাতো ৫. কাজল মাহাতো ৬. মঙ্গল সরেন ৭. সনাতন সরেন ৮. শুকলাল সরেন ৯. কানাই হাঁসদা ১০. রাজেশ হাঁসদা ওরফে ভাঁটু ১১. শ‌্যামচরন হাঁসদা ১২. রাজেশ মুণ্ডা ১৩. ইন্দ্রজিৎ কর্মকার। এঁদের মধ্যে ১২ জনই এই মামলাতে জেলবন্দী ছিলেন। শুধুমাত্র ইন্দ্রজিৎ কর্মকার এই মামলায় জামিনে মুক্ত থাকলেও, অন্য মামলায় জেলেই ছিলেন। ২৩ জনের মধ্যে বাকি ১০ জনের (১৪. রঞ্জন মুন্ডা ১৫. লোচন সিং সর্দার ১৬. চুনারাম বাস্কে ১৭. আশিষ মাহাতো ১৮. ধৃতিরঞ্জন মাহাতো ১৯. বিষ্ণু সরেন ২০. অর্ণব দাম ২১. রামসাই হাঁসদা ২২. প্রশান্ত পাত্র এবং ২৩. বুদ্ধেশ্বর মাহাতো) সাজা ঘোষণা করা হবে আগামীকাল। এদিকে, এদিন যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণার পরই মেদিনীপুর আদালত চত্বরে বিক্ষোভ দেখান APDR সংগঠনের সদস্যরা। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মনসারাম হেমব্রম ওরফে বিকাশ দাবি করেন, “জঙ্গলমহলের মানুষকে ফাঁসানো হয়েছে। সিপিএমের সরকার আমাদের অ্যারেস্ট করেছিল। আর মমতা সরকার সাজা দিল! যারা এখানে সাক্ষী দিয়েছে সব সাজানো।” অন্যদিকে, শালবনীর বেলাশোল এলাকার বাসিন্দা তথা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মানস মাহাত’র স্ত্রী নমিতা মাহাতোর বক্তব্য, “মমতার সরকারের কি এটা বিচার হলো? ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জঙ্গলমহলের সমস্ত বন্দীদের মুক্তি দেবেন। আর আজ এটা কি হল? জাগরী বাস্কে, সুচিত্রা মাহাতো-রা ক্যামেরার সামনে দোষ স্বীকার করেও, কিছু হলোনা! আর আমার স্বামী (মানস মাহাত) সহ বাকিরা চাষবাস করছিল। তাদের তুলে এনে গ্রেপ্তার করে, এখন যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হল!”

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঝাড়গ্রামের শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে (EFR Camp) ভয়বাহ মাও হামলায় (Maoist Attack) প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৪ জন জওয়ান। দীর্ঘ বিচার-প্রক্রিয়া শেষে মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সেই মামলাতেই ২৩ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে মেদিনীপুর জেলা আদালত (Midnapore Judges Court)। ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঠিক সন্ধ্যার মুখে শিলদা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে থাকা EFR ক্যাম্পে ভয়াবহ হামলা চালায় মাওবাদীরা। জওয়ানরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি করে, ক্যাম্পে আগুন লাগিয়ে ২৪ জন EFR জওয়ানকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে বিকাশ, তারা সহ মাওবাদীদের একটি দল। জওয়ানদের পাল্টা প্রতিরোধে ৫ জন মাওবাদীরও মৃত্যু হয়েছিল। মাও নেতা কিষেণ জী-র নির্দেশি এই হামলা চলে! ভয়াবহ এই হামলার পরই ওই জায়গা থেকে EFR ক্যাম্প তুলে দেওয়া হয়েছিল। সেই EFR ক্যাম্পের অদূরে (শিলদাতেই) করা হয় রাজ্য পুলিশের স্ট্রাকো ক্যাম্প। এই মামলায় প্রথম গ্রেপ্তার হন মাও নেতা রঞ্জন মুন্ডা। তারপর, একের পর এক মাও নেতা-নেত্রী গ্রেপ্তার হন। অধরা ছিলেন মাও নেত্রী সুচিত্রা মাহাত, জাগরী বাস্কে সহ কয়েকজন। পরে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন সুচিত্রা, জাগরী-রা। এখন তাঁরা সুখে ঘর-সংসার করছেন। রাজ্য পুলিশে দেওয়া হয়েছে চাকরি। FIR-এ নাম থাকলেও চার্জশিট থেকে তাদের নাম বাদ যায় বলে অভিযোগ বিকাশ, তারা সহ চার্জশিটে নাম থাকা ২৪ জনের পরিবারের সদস্য থেকে তাঁদের আইনজীবীদের। এঁদের মধ্যে (২৪ জনের মধ্যে) সুদীপ চোংদার (ওরফে কাঞ্চন) নাম এক পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার এক মাওবাদী নেতার মৃত্যু হয় বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন। বাকি ২৩ জনকেই মঙ্গলবার দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বুধবার তাদের মধ্যে ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণা করেন মেদিনীপুর জেলা আদালতের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক সেলিম শাহী। আর তারপরই মেদিনীপুর আদালত চত্বরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সাজা প্রাপ্তদের পরিবারের লোকজন থেকে শুরু করে APDR-র সদস্যরা। তাঁদের দাবি, বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। তাঁরা হাইকোর্টে আবেদন করবেন।

thebengalpost.net
বুধবার মেদিনীপুর আদালতে: