দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, মেদিনীপুর, ১৬ ফেব্রুয়ারি: “উত্তরা তোমার বিরুদ্ধে অনেক কমপ্লেন আসছে। আমি এক মাস সময় দিচ্ছি, নিজেকে শুধরে না নিলে, জেলা পরিষদ আমি চেঞ্জ করে দেব।” ২০২২ এর ১৭ মে। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সদর মেদিনীপুরের প্রদ্যোৎ স্মৃতি সদনে অনুষ্ঠিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক রিভিউ মিটিং। গড়বেতা ৩ নং ব্লকের কড়সা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় বনদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই কয়েক হাজার গাছ কাটা নেওয়া সহ জেলা পরিষদের আরও কয়েকটি ইস্যুতে সভাধিপতি তথা গড়বেতার বিধায়ক উত্তরা সিংহ হাজরা-কে ঠিক এভাবেই ভর্ৎসনা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক কয়েক মাস পর, আগস্ট (২০২২) মাসের ২৭ তারিখ। শালবনীর বিধায়ক তথা প্রতিমন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতোর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। যেখানে জুন মালিয়া, সায়ন্তিকা চট্টোপাধ্যায় সহ দলের একাধিক রাজ্য, জেলা ও ব্লক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ‘বিস্ফোরক’ (বিতর্কিতও) মন্তব্য করেছিলেন শ্রীকান্ত। স্বাভাবিকভাবেই, সেই ভিডিও মিডিয়ার হাতে পৌঁছতেই তা হয়ে যায় ‘মুখরোচক খবর’! তৃণমূলের অন্দরমহলে শোরগোল পড়ে যায়। ক্ষুব্ধ জুন মালিয়া (মেদিনীপুরের বিধায়ক) মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুযোগ করেন! ঘটনার ২-৩ দিনের মধ্যেই (৩১ আগস্ট, ২০২২) মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি শ্রীকান্ত মাহাতোকে নির্দেশ দেন, “শ্রীকান্ত, তুমি জুনের কাছে ক্ষমা চাও!” তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ওই দিনই শ্রীকান্ত মাহাতোর এসকর্টও তুলে নেওয়া হয়। শ্রীকান্ত ক্ষমা চেয়েছিলেন কিনা, পরবর্তী সময়ে সেই সদুত্তর কোন পক্ষ থেকেই পাওয়া না গেলেও; ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। ওই বছরই (২০২২) অক্টোবর মাসে খড়্গপুর শিল্পতালুকের প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের মিলিয়ে দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। যদিও, দু’জনের ‘সম্পর্ক’ হয়তো এখনও ‘শীতল’! তবে, মুখ্যমন্ত্রী তথা ‘দিদি’র কাছে ধীরে ধীরে যেন ‘শ্রীকান্ত’ কিছুটা আগের মতোই স্নেহের ‘উষ্ণতা’ ফিরে পাচ্ছেন। আর, উত্তরা-ও।

thebengalpost.net
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুরের সভায়:

বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) মেদিনীপুর কলেজ কলেজিয়েট মাঠের সভায় (সরকারি পরিষেবা প্রদান অনুষ্ঠানে) অন্তত তেমনটাই ধরা পড়লো। একইসঙ্গে চোখে পড়লো মেদিনীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান সৌমেন খানের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর ‘উপেক্ষা’ (ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত?)! বৃহস্পতিবার মঞ্চে পরিষেবা প্রদানের সময় মুখ্যমন্ত্রী সবার আগে কাছে টেনে নেন ঘাটালের সাংসদ তথা তাঁর প্রিয় দেব ওরফে দীপক অধিকারী’কে। একপ্রকার জোর করেই দেবের কোলে তুলে দেন ফুটফুটে এক শিশুকে। তারপর, নিজে ধামসা মাদল বাজানোর পর সেই কাঠি তুলে দেন দেবের হাতে।‌ এরপর, একে একে ডেকে নেন তাঁর ‘প্রিয়’ জুন মালিয়া, মন্ত্রী শিউলি সাহা, সাংসদ অপরূপা পোদ্দার, বিধায়ক ও সভাধিপতি উত্তরা সিংহ হাজরা, বিধায়ক ও সহ-সভাধিপতি অজিত মাইতি, প্রতিমন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতোকে। সবটাই চলছিল স্বাভাবিকভাবে। একে একে আসেন বিধায়ক দীনেন রায়, হুমায়ূন কবীর, সূর্য অট্ট, বিক্রম প্রধান, মমতা ভূঁইয়া, অরূপ ধাড়া সকলেই।‌ এরপর আসেন চন্দ্রকোনা, ঘাটাল, খড়ার, ক্ষীরপাই, রামজীবনপুর, খড়্গপুর পৌরসভার চেয়ারম্যানরা (খড়্গপুরের ক্ষেত্রে অবশ্য ভাইস চেয়ারম্যান)। এরপরই আসেন মেদিনীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান সৌমেন খান। সেই সময় ‘চোখের আলো’ প্রকল্পের চশমা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন সঞ্চালক তথা জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক বরুণ মণ্ডল। মুখ্যমন্ত্রীর বাম দিকে দাঁড়িয়ে থাকা সৌমেন খান-কে ‘খেয়াল না করেই’ একটি মেয়েকে নিজের হাতে চশমা পরিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তারপর অবশ্য দেখেন সৌমেন-কে (বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে যাঁর হাতে তৃণমূলের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই)! তবে, দেখলেও সৌমেন-কে এদিন পরিষেবা প্রদানের কোন ‘সুযোগ’ দেননি মুখ্যমন্ত্রী।‌ পাশে সৌমেন খান দাঁড়িয়ে থাকলেও, পরবর্তী উপভোক্তার চোখেও নিজের হাতেই চশমা পরিয়ে দেন মমতা। এরপরও, ‘সুযোগ’ দেননি! ডেকে নেন মুখ্য সচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী সহ আমলা ও পুলিশ প্রশাসনের আধিকারিকদের। ততক্ষণে অবশ্য জেলা পুলিশ সুপার দীনেশ কুমারের ‘অনুরোধে’ জায়গা ছাড়েন মেদিনীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান!

thebengalpost.net
দিদির ডাকে শ্রীকান্ত:

এই ‘দৃশ্য’ যে খুব একটা ‘স্বাভাবিক’ নয় তা মানছেন জেলা ও শহর (মেদিনীপুর) তৃণমূলের একাংশ। তাঁদের মতে, “অতীতেও দলনেত্রী তাঁর ইঙ্গিতে বা ব্যবহারেই অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন!” বিশেষত, ‘কে আপন আর কে পর!’ বিষয়টি খেয়াল করেছেন জেলা ও শহর রাজনীতিতে জুন (বিধায়ক জুন মালিয়া) – সৌমেন (চেয়ারম্যান সৌমেন খান) অনুগামী থেকে সুজয় (জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা) – বিশ্বনাথ (শহর সভাপতি বিশ্বনাথ পাণ্ডব) অনুগামীরাও। তাঁদের মধ্যেই শহর যুব তৃণমূলের নেতা প্রসেনজিৎ পান্ডব আজ সন্ধ্যাতেই একটি ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট করেছেন, “অর্থ দিয়ে সব কেনা যায়। কিন্তু, কারো স্নেহ ভালবাসা কেনা যায় না। আজ আবার তা প্রমাণিত।” সুজয়ের এক অনুগামীও একটি পোস্ট করেছেন আজ সন্ধ্যাতেই, “সত্যের কাছে তোমাকে পরাজিত হতেই হবে। শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা!” ইতিমধ্যে, এ নিয়ে নেট মাধ্যম উত্তাল। যদিও, গত কয়েকদিনে চেয়ারম্যান সৌমেন খান দিন রাত এক করে শহরের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে একাধিক কাজ করিয়েছেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। তা সত্ত্বেও কেন এই ‘ঘটনা’? অনেকেই মনে করাচ্ছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মেদিনীপুর পৌরসভার ১১ জন কাউন্সিলর (২০ জনের মধ্যে) এর বিদ্রোহ ঘোষণা করে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে চিঠি পাঠানোর ঘটনা থেকে শুরু করে দিনকয়েক আগেই ১৪ নং ওয়ার্ডের নির্দল কাউন্সিলর (বহিষ্কৃত তৃণমূল নেত্রী) এর ‘স্তুতিগান’ এর কথা! তবে কি মেদিনীপুরের ‘খেলা’ ঘুরতে চলেছে? গত ৪ ফেব্রুয়ারি কেশপুরের আনন্দপুরে নাকি সংসদ তথা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তেমনই এক ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন! এবার কি দলনেত্রীও? সময়ই বলবে। তবে, জেলা তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, “পুরোটাই আপনাদের মিডিয়ার রটনা!”

thebengalpost.net
মুখ্যমন্ত্রীর পাশে তখন মেদিনীপুরের চেয়ারম্যান: