Midnapore

Midnapore: বিপ্লবের শহর মেদিনীপুরে জেলাশাসকের বাংলো বড়লাটের নামে! ‘হেস্টিংস হাউস’ হোক শহীদের নামে, উঠছে দাবি

মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১১ মে: এই শহর সংগ্রামের কথা বলে। অত্যাচারী জেলাশাসকদের হত্যা করে ‘শহীদ’ হওয়া বীরদের গল্প শোনায়। ব্রিটিশের কাছে মাথা নত না করে, বিপ্লবের ধ্বজা ওড়ানোর মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। শত শহীদের সেই শহর মেদিনীপুর। পেডি-ডগলাস-বার্জ নামক তিন অত্যাচারী ব্রিটিশ জেলাশাসককে পর পর তিনবছরে (১৯৩১, ১৯৩২, ১৯৩৩) এই শহরের মাটিতেই হত্যা করার ‘নায়ক’ বিমল দাশগুপ্ত, জ্যোতিজীবন ঘোষ, প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, প্রভাংশু শেখর পাল, অনাথ বন্ধু পাঁজা, মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, নির্মল জীবন ঘোষ, রামকৃষ্ণ রায়- দের স্মৃতিধন্য এই শহর। ‘বিপ্লবীদের আঁতুড়ঘর’ সেই মেদিনীপুর শহরের বুকে, জেলাশাসকের বাংলোর নাম আজও এক বড়লাটের নামে। ভারতবর্ষের প্রথম গভর্নর জেনারেল (১৭৭৪-১৭৮৫) তথা বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস (Warren Hastings) এর আমলে নির্মিত, তাঁরই নামাঙ্কিত পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসকের সেই বাংলোর নাম- ‘হেস্টিংস হাউস’ (Hastings House)। মেদিনীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কালেক্টরেট ভবন বা জেলাশাসকের কার্যালয়ের ঠিক উল্টোদিকেই এই ভবন। এই ভবনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে মেদিনীপুরবাসী সচেতন। প্রায় ২৫০ বছরের সুপ্রাচীন এই ভবনটিকে সম্প্রতি (৬ ডিসেম্বর, ২০২১) রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে হেরিটেজ (Heritage) ঘোষণা করাও হয়েছে। তবে, সেই ঐতিহ্য এবং প্রথম বড়লাটের ইতিহাস-কে অস্বীকার না করেও, আপামর মেদিনীপুরবাসী চাইছেন এই ভবন বা চত্বরের নামকরণ করা হোক মেদিনীপুরের কোনো স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামে। মেদিনীপুরবাসীর মতে, স্বাধীনতা সংগ্রামের পীঠস্থান এই শহরের বুকে জেলাশাসকের বাংলোর নাম ‘হেস্টিংস হাউস’ বড্ড বেমানান! তাই, ভবনের বাইরে নির্মিত সুদৃশ্য তোরণে বড়লাটের নাম নয়, বরং জ্বলজ্বল করে উঠুক ‘রত্নগর্ভা’ মেদিনীপুরের কোনো শহীদ বা মুক্তিযোদ্ধার নাম।

মেদিনীপুরের হেস্টিংস হাউস (Hastings House), নিজস্ব চিত্র :

যাঁদের বলিদানে বা আত্মোৎসর্গে এই দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে ব্রিটিশরা, তাঁদের অন্যতম পীঠস্থান অবিভক্ত মেদিনীপুরের এই জেলা সদর তথা বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা শহর মেদিনীপুর (Midnapore)। সেই মেদিনীপুরের বুকে ব্রিটিশ বড়লাটের নামে ‘হেস্টিংস হাউস’ বা অত্যাচারী জেলাশাসকের নামে ‘বার্জ টাউন’; মেনে নিতে পারছেন না শহরের সচেতন নাগরিকরা। পরোক্ষে তাঁদের সমর্থন জানাচ্ছেন জনপ্রতিনিধি কিংবা প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত মেদিনীপুরের ভূমিপুত্ররাও। তবে, বিতর্কিত এই অধ্যায়ের ‘অবসান’ বা সুষ্ঠু সমাধান কিভাবে হবে, তা নিয়েই দ্বিধাগ্রস্ত অনেকে! আগামী মঙ্গলবার (১৭ মে) জেলা শহর মেদিনীপুরে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকেই তাই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন বিষয়টি। অনেকেই যেমন চাইছেন, কিশোর বিপ্লবী প্রদ্যোৎ-প্রভাংশু’রা যে ঐতিহাসিক জেলা পরিষদ ভবনে অত্যাচারী জেলাশাসক ডগলাস-কে হত্যা করেছিলেন (৩০ এপ্রিল, ১৯৩২), সেই ভবনটিও প্রদ্যোৎ-প্রভাংশুদের নামাঙ্কিত করে, ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হোক। ঠিক তেমনই অনেকে চাইছেন, ‘হেস্টিংস ভবন’ এর ভেতরের ‘ইতিহাস’ অক্ষুন্ন রেখেও ভবনের নামকরণ হোক মেদিনীপুরের কোনো বিপ্লবীর নামে। মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা, বিশিষ্ট শিক্ষক ও গবেষক অতনু মিত্র যেমনটা বললেন, “ওয়ারেন হেস্টিংসদের অত্যাচারী ব্রিটিশ বাহিনীকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করে স্বাধীনতা এনেছিলেন ভারতবর্ষের বিপ্লবীরা। শহীদ হয়েছিলেন মেদিনীপুরেরও কতশত বীর। তাই, মেদিনীপুর শহরে এই ‘হেস্টিংস হাউস’ বড্ড আঘাত দেয়। ভেতরের কক্ষ, হেস্টিংসের বিচারসভা, তাঁর ইতিহাস সবকিছু যেমনটা আছে থাক, শুধু ভবন বা চত্বরের নাম কোনো শহীদের নামে করা হোক। এটাই আবেদন।” শহরের বিশিষ্ট আইনজীবী তথা রাণী শিরোমণির স্বীকৃতি সংক্রান্ত আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ তীর্থঙ্কর ভকত কিছুটা ক্ষোভের সুরে বললেন, “সরকার বদল হলেও, মেদিনীপুর সম্পর্কে মনোভাব বদল হয়নি!”

ওয়ারেন হেস্টিংস (Warren Hastings) এর ছবি গুগল (Google) থেকে সংগৃহীত :

অপরদিকে, মেদিনীপুরের শিক্ষক, সমাজকর্মী ও লেখক অমিত কুমার সাহু থেকে মেদিনীপুরের ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণারত অরিন্দম ভৌমিক- প্রমুখরাও এনিয়ে তাঁদের আবেদন তুলে ধরলেন। অমিত জানালেন, “বার্জটাউন যেমন বেমানান, তেমনই হেস্টিংস হাউস! একবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বার্জটাউনের নাম পরিবর্তন করার, শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। আমাদের মেদিনীপুরবাসীর দাবি, হেস্টিংস হাউসের নামও মেদিনীপুরের বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামে করা হোক।” অরিন্দম বলেন, “বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস এর ইতিহাস আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। তাঁর আমলেই এই ভবন নির্মিত হয়েছে। সেই ইতিহাস সংরক্ষিত আছে এবং থাকবে। তবে, ভবনের বাইরের ওই সুদৃশ্য তোরণে তাঁর নামটা না থাকলেই ভালো হত।” তিনি অবশ্য এও দাবি জানিয়েছেন, “মেদিনীপুর শহরের প্রতিটি অলিতে-গলিতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস আর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মর্যাদা দেওয়া হোক সেই সব কিছুকে। ‘আই লাভ মেদিনীপুর’ নয় ‘শহীদদের শহর মেদিনীপুর’ নামে চিহ্নিত হোক বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলি।” শহরের বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক ও সমাজকর্মী সুজয় হাজরা-ও জানিয়েছেন, “মেদিনীপুর মানে স্বাধীনতা ‌সংগ্রামের ইতিহাস আর আবেগ। সেই আবেগে সত্যিই আঘাত হানে ‘হেস্টিংস হাউস’ এর মতো নামগুলি। ইতিহাস বা স্থাপত্য-কে স্বীকৃতি দিয়েও, নাম বদলানোর যে দাবি মেদিনীপুর বাসী করছেন, তা সঙ্গত।” মেদিনীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান সৌমেন খান-ও জানিয়েছেন, “ইতিহাসে থাকুন হেস্টিংস। তাঁর কৃতিত্ব বা‌ নাম থাকুক ভেতরের ফলকে। বাইরের নামকরণ মেদিনীপুরের কোনো মুক্তিযোদ্ধা’র নামে হতেই পারে। আমরা বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয়ই যথাস্থানে আলোচনা করব।” মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা তথা MKDA চেয়ারম্যান ও বিধায়ক দীনেন রায় জানিয়েছেন, “বিতর্কিত বিষয়। দীর্ঘদিনের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। তবে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেদনীপুরবাসী যদি দাবি করেন, সেই দাবি নিয়ে আমরা বৈঠক করতে পারি। সেখানে দলমত নির্বিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করবেন। যদি, সর্বসম্মতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত উঠে আসে, তবে আমরা নিশ্চয়ই প্রশাসনিকভাবে বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি।”

ঐতিহাসিক মেদিনীপুর শহর (কলেজ কলেজিয়েট রোড), নিজস্ব চিত্র :

News Desk

Recent Posts

Midnapore: “নাটক ছেড়ে বিচার কর, নেংটি ছেড়ে ধেড়ে ধর!” মশাল হাতে শহর মেদিনীপুরের রাজপথ কাঁপাল জাতীয় কংগ্রেস

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৮ সেপ্টেম্বর: ৯ আগস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর। বিচার পায়নি…

5 hours ago

Midnapore: “আচ্ছা, তুমি একা ঘুমাও?” ছাত্রীদের ‘আপত্তিকর’ বার্তা পাঠানো মেদিনীপুর কলেজের অস্থায়ী কর্মীকে ঘিরে ‘বিতর্ক’

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৮ সেপ্টেম্বর: "হাই" দিয়ে শুরু। তারপর, "আচ্ছা, আমার সঙ্গে…

8 hours ago

Medinipur: পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল পরিবেশন থেকে ছাত্রীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক বার্তা! দিনভর নানা কর্মসূচিতে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৭ সেপ্টেম্বর: প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়াদের নিজের হাতে মিড-ডে মিল…

1 day ago

Midnapore: মেদিনীপুর মেডিক্যালের মুস্তাফিজুর সহ সন্দীপ-ঘনিষ্ঠ তিন ‘চিকিৎসক-নেতা’কে সাসপেন্ড করল মেডিক্যাল কাউন্সিল! বাতিল হতে পারে সন্দীপের রেজিস্ট্রেশন

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৭ সেপ্টেম্বর: অবশেষে প্রবল চাপের মুখে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল…

1 day ago

Medinipur: শিক্ষক দিবসের দিনই বিদ্যালয়ের ক্যান্সার আক্রান্ত ছাত্রের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য পশ্চিম মেদিনীপুরের পড়ুয়া ও শিক্ষকদের

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৬ সেপ্টেম্বর: জঙ্গলমহল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার প্রত্যন্ত শালবনী ব্লকের…

2 days ago

Midnapore: শিক্ষক দিবসেই ‘চক্ষু পরীক্ষা শিবির’ পশ্চিম মেদিনীপুরের স্কুলে; CCTV বসানোর জন্য ১ লক্ষ টাকা অনুদানের ঘোষণা সহৃদয় ব্যক্তির

দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৬ সেপ্টেম্বর: সারা বছর তাঁরা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেন…

3 days ago