দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৪ আগস্ট: “অন্যায়ের সাথে সহবাস করতে না পারার জন্য, মা তোমায় যে দাম দিতে হল, তার জন্য তোমায় সেলাম। তবে যে ঝড় উঠেছে, তার সাথী হলাম। জানিনা কতটা কাজ হবে!” আর জি কর মেডিক্যালের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পথে নেমে সোচ্চার হওয়া ছাড়াও সমাজমাধ্যমেও ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন ‘প্রাক্তন’ বিচারক অঞ্জলি সিনহা। মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা, প্রাক্তন বিচারক সিনহা ১৪টি জেলা ও দায়রা আদালত বা জেলা জজ কোর্টের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে, ‘প্রাক্তন’ বিচারক ছাড়াও তাঁর অন্যতম পরিচয় তিনি মেদিনীপুর শহরের ঐতিহ্য মণ্ডিত বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ (বালক)-র পরিচালন সমিতির সভাপতি (President)। বিধায়ক (মেদিনীপুর) ‘মনোনীত’ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বছর দুয়েক আগে (২০২২-র জুলাই) এই পদপ্রাপ্তি হয়েছে তাঁর! যদিও, এজন্য নিজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বিরত হতে বা সত্ত্বার সঙ্গে সমঝোতা করতে যে তিনি পারবেন না, শুক্রবার (২৩ আগস্ট) তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রাক্তন বিচারক অঞ্জলি সিনহা।

thebengalpost.net
প্রাক্তন বিচারক অঞ্জলি সিনহার পোস্ট:

প্রসঙ্গত, আর জি কর মেডিক্যালের নৃশংস ও পাশবিক ঘটনার পর থেকেই একজন ‘সংবেদনশীল’ নাগরিক হিসেবে সমাজমাধ্যমে সরব হয়েছেন অঞ্জলি দেবী। এক্ষেত্রে তাঁর বেশ কিছু পোস্ট শাসকদলকে যথেষ্ট বিড়ম্বনায় ফেলেছে বলে ‘অভিযোগ’ শাসকদল প্রভাবিত শিক্ষক সংগঠনের একাংশ থেকে জেলা ও শহর তৃণমূলের বেশ কিছু নেতাদের। এ নিয়ে শাসকদলের সক্রিয় কর্মী-সমর্থকদের বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও ‘অভিযোগ’ আনা হয়েছে। সমাজমাধ্যমে করা প্রাক্তন বিচারক অঞ্জলি সিনহার বিভিন্ন পোস্টের স্ক্রিনশট শেয়ার করে লেখা হয়েছে- “শাসকদলের বদান্যতায় একটি স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি হয়েও বিড়ম্বনায় ফেলছেন শাসকদলকেই!” সেই সমস্ত পোস্টের মধ্যে আছে অঞ্জলি দেবীর লেখা একটি প্রতিবাদী কবিতা থেকে শুরু করে নিজস্ব বেশকিছু মতামত এবং সরকারবিরোধী কিছু শেয়ার করা ভিডিও। এ নিয়ে অবশ্য বিন্দুমাত্র বিচলিত বা অনুতপ্ত নন প্রাক্তন বিচারক অঞ্জলি সিনহা। তিনি জানিয়েছেন, “এরকম একটি নৃশংস ঘটনা। একটি ফুটফুটে মেয়ে আজ নিজের কর্মস্থলে পরিষেবা দিতে গিয়ে পাশবিক অত্যাচারের শিকার হয়ে প্রাণ দিল। সে তো আমাদেরই মেয়ে। এই সমাজের সকল মায়েদের, সকল পরিবারেরই একজন মেয়ে, বোন কিংবা দিদি। আমি নিজে একজন মেয়ে হয়ে, সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হয়ে কিভাবে চুপ থাকব? চুপ থাকা যায়?” তাঁর সংযোজন, “আমার কোনও পোস্ট যদি তাঁদের বিড়ম্বনায় ফেলছে বলে মনে হয়, আমাকে সরাসরি জানানো হোক; আমি সেই মুহূর্তেই ইস্তফা দিতে রাজি! আমি পদের জন্য লালায়িত নই। এই পদটিও আমাকে ওঁরা দিয়েছেন। আমি নিজে থেকে কখনোই ইচ্ছে প্রকাশ করিনি!”

thebengalpost.net
অঞ্জলি সিনহার ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত:

উল্লেখ্য যে, বর্বরোচিত নির্যাতন আর অত্যাচারে আর জি করের মহিলা চিকিৎসক নিহত হওয়ার পর অঞ্জলি দেবী ফেসবুকে লিখেছিলেন, “উই ওয়ান্ট জাস্টিস/কোথায় জাস্টিস/আমার বাবা নেতা/কে পাবে জাস্টিস/আমরা টাকা পাঠাই/আমরা করব জাস্টিস/আমাদের লোকবল আছে/আমাদের প্রশাসন আছে/তথ্য লোপাট/কিভাবে হবে জাস্টিস….!” সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলা করার পর তিনি লিখেছিলেন, “অনারেবল সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করে হস্তক্ষেপ করেছেন। আমাদের বঙ্গবাসীদের বিনীত নিবেদন, আমাদের ট্যাক্সের টাকায় পালিত আধিকারিক ও প্রশাসন জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়।” তবে, এসব নিয়ে শুক্রবার শহর মেদিনীপুরের বাসিন্দা, প্রাক্তন এই বিচারককে ফোন করা হলে তিনি বলেন, “যা লেখার, যেভাবে প্রতিবাদ করার করেছি। এই মুহূর্তে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আর কোনও মন্তব্য করব না। করা উচিতও নয়। আমি নিজেও একদিন এই বিচার ব্যবস্থার একটা অংশ হিসেবে কাজ করেছি। তাই জানি, আদালত কথা বলে তথ্যের ভিত্তিতে। আবেগ বা তৃতীয় নেত্র দিয়ে অনুভব করার কোনও সুযোগ নেই! একজন নাগরিক হিসেবে শুধু চাইব, আমরা সকলেই যেন ‘সুবিচার’ পাই!” কিন্তু, আপনার কিছু পোস্ট, শাসকদলকে বিড়ম্বনায় ফেলছে বলে অভিযোগ? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রাক্তন বিচারক বলেন, “এটা ঠিক, বিধায়ক (মেদিনীপুরের সদ্য প্রাক্তন বিধায়ক এবং বর্তমান সাংসদ জুন মালিয়া) চেয়েছেন বলেই এই পদে আমি আসীন। কিন্তু, সেজন্য তো নিজের সত্ত্বার সঙ্গে আপোষ করতে পারবনা। এতদিন শিরদাঁড়া সোজা রেখে কাজ করেছি, এখনও সেটাই করব।” এ নিয়ে মেদিনীপুর শহরের শাসকদলের এক নেতা বলেন, “উনি প্রতিবাদ করছেন, করুন। আমরা সকলেই এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ করছি। পথে নেমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বা ফাঁসি চাইছি। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী প্রথম দিন থেকেই দ্রুত বিচার এবং ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু, সেজন্য লক্ষ্মীর ভান্ডারকে ব্যঙ্গ করে কিংবা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছোট করে যেসমস্ত পোস্ট করা হচ্ছে, তা উনি নিজের টাইম লাইনে কেন শেয়ার করেছেন জানি না! আমাদের দলের (তৃণমূলের) বিধায়কের সুপারিশেই উনি একটি সম্মানজনক পদ পাওয়া সত্ত্বেও, এসব করার জন্য নিঃসন্দেহে আমাদের দলের মুখ পুড়ছে। উনি যদি পদত্যাগ করে এসব করতেন, তাহলে কিছু বলার ছিলো না!” এনিয়ে প্রাক্তন বিচারক সিনহা বলেন, “আমাকে যে পদ দেওয়া হয়েছে, আমি সততার সঙ্গে সেই পদের মর্যাদা রেখে কাজ করে চলেছি। যখন বলবেন, ছেড়ে দেব। যদিও, আমাকে সরাসরি এই বিষয়ে কেউই কিছু বলেন নি! আপনাদের মাধ্যমেই শুনছি। আর, আমি মুখ্যমন্ত্রী বা সরকারের বিরোধিতা কোথাও করিনি! আমি শুধু স্বাধীনভাবে নিজের মতপ্রকাশ করেছি। ভবিষ্যতেও তাই করে যাব।”

thebengalpost.net
প্রতিবাদ: