দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৩১ ডিসেম্বর: ‘ফিলোডস টিউমার’ (Phyllodes tumor) হল বিরল টিউমার যা স্তনের সংযোগকারী টিস্যুতে শুরু হয়। তার সঙ্গে যখন ইনসুলিন লাইক গ্রোথ ফ্যাক্টর (IGF-2) যুক্ত হয়, তা ‘অতি-বিরল’ টিউমারে পরিণত হয়। তেমনই অতি-বিরল ‘ফিলোডস টিউমার’ অপারেশন করে গৃহবধূর প্রাণ রক্ষা করলেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। সেই সঙ্গে গড়লেন নজিরও! মেদিনীপুর মেডিক্যালের চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, মহিলার স্তনে থাকা ফিলোডস টিউমারের ওজন ছিল ৫ কেজি। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ২০ সেন্টিমিটার। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে এর আগে এই ধরনের বিরল অস্ত্রপচার গোটা বিশ্বে মাত্র ১২ জনের হয়েছে (জার্নালে নথিবদ্ধ)।
জানা যায়, দাঁতন থানা এলাকার বাসিন্দা ভূতনাথ কিস্কুর স্ত্রী খুকুমণি কিস্কুর। দু’জনই দিন মজুরির কাজ করেন। তাঁদের একটি কন্যা সন্তানও আছে। মাসখানেক আগে আচমকা বাড়িতেই অজ্ঞান হয়ে যান খুকুমণি দেবী। পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ভাবেন সুগার ফল করেছে। তাঁকে দ্রুত বেলদা গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় চিকিৎসা। তবে, প্রাথমিক চিকিৎসার পরই বেলদা গ্রামীণ হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাঁকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। সেইমত তাঁকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শুরু হয় চিকিৎসা। শুরুতেই লক্ষ্য করা যায়, তাঁর শরীরে দ্রুত হারে সুগার ফল হচ্ছে। এদিকে, সুগার ফল হওয়ার কারণ বুঝে উঠতে পারছিলেন না চিকিৎসকরা। এরপরই, চিকিৎসকেরা জানতে পারেন, তাঁর ডান স্তনে একটি বড় আকারের টিউমার আছে। যা ওই মহিলা প্রায় ৭-৮ বছর বয়ে বেড়াচ্ছেন! বলা ভালো, এদিক-ওদিক চিকিৎসা করিয়ে তাকে ‘বড়’ করে তুলেছেন। এর মধ্যেই অবশ্য দাঁতনের এক চিকিৎসক খুকমণি-কে তাঁর টিউমার অপারেশনের কথা বলেন। কিন্তু, অভাবের সংসারে এতবড় অপারেশনের খরচ কিভাবে আসবে, ভাবতে ভাবতেই দিন চলে যায়।
মাসখানেক আগে খুকুমণি হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গেলে বাড়ির লোক আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং তড়িঘড়ি প্রথমে বেলদা গ্রামীণ হাসপাতাল এবং পরে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে আসেন। মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা দেখেন, ফিলোডস টিউমার রয়েছে গৃহবধূর স্তনে। এতে আবার ইনসুলিন লাইক গ্রোথ ফ্যাক্টর (IGF-2) রয়েছে। যা একেবারে বিরল! আর এর থেকেই গৃহবধূর ব্লাড সুপার বার বার ফল করছিল। কিন্তু, ইনসুলিন লাইক গ্রোথ ফ্যাক্টর-২ (IGF-2) টেস্টের সুবিধা এদেশে নেই। আর এই টেস্ট খুবই ব্যয় সাপেক্ষ। তবে, দক্ষতার সঙ্গে রোগের ডায়াগনসিস করেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকরা। এরপর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জেনারেল মেডিসিন, জেনারেল সার্জারি, কার্ডিওলজি ও অ্যানাস্থেসিওলজি বিভাগের সিনিয়র ডাক্তারদের সমন্বয়ে একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। শুরু হয় অস্ত্রোপচারের পরিকল্পনা। গত সপ্তাহে চিকিৎসকরা প্রায় দু’ঘন্টা ধরে অস্ত্রপচার করেন। এই মুহূর্তে খুকমণি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন বলে সোমবার সন্ধ্যায় হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। অস্ত্রোপচারের পর থেকে তাঁর আর সুগার ফল করেনি। তাঁকে জেনারেল বেডেও দেওয়া হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলেও জানা গেছে হাসপাতাল সূত্রে। ওই বোর্ডে থাকা এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, “বেশি দেরি করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারত। সম্ভবত দেশে এই ধরনের অস্ত্রপচার প্রথম হল।” টেস্ট না করেও শুধুমাত্র ডায়াগনসিস বা সঠিক রোগ নির্ণয়ের মধ্য দিয়ে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা যে কার্যত অসাধ্য সাধন করেছেন, তা মানছেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সুপার ডঃ জয়ন্ত কুমার রাউত। চিকিৎসকদের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন খুকমণি’র স্বামী ভূতনাথ সহ পরিবারের সদস্যরা।