দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৭ ফেব্রুয়ারি:”বিভিন্নভাবে এই অর্পিতা নায়েককে হারানোর জন্য, পুলিশ থেকে শুরু করে অনেক রকম চক্রান্ত করেছিল! শুধুমাত্র আপনারা পাশে থেকে রক্ষা করেছিলেন বলে অর্পিতা রায় নায়েক আজ পৌরসভার কাউন্সিলর হয়েছে, আপনাদের সেবা করার জন্য! পুলিশকে কাজে লাগিয়েছিল, বাইরে থেকে মস্তানদের কিছু এনেছিল, মা বোনেদের ভয় দেখানো থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে চক্রান্ত করেছিল। কিন্তু, পারেনি!” দলবিরোধী কাজের জন্য তৃণমূল থেকে ৬ বছরের জন্য বহিষ্কৃত মেদিনীপুর পৌরসভার ‘নির্দল’ কাউন্সিলর অর্পিতা রায় নায়েককে পাশে বসিয়ে এভাবেই নিজের দল (তৃণমূল) থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ‘বিস্ফোরক’ মন্তব্য করতে শোনা গেল পৌরপ্রধান সৌমেন খান-কে। রবিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার পর থেকেই সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে (সত্যতা যাচাই করেনি বেঙ্গল পোস্ট ডিজিটাল মাধ্যম)। আর, সেই ভিডিও ঘিরেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে মেদিনীপুর শহর জুড়ে। মঙ্গলবার বিকেলে দলেরই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ধিক্কার মিছিল করেছে ১৪ নং ওয়ার্ড তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূলের শহর সভাপতি তথা মেদিনীপুর পৌরসভার ১৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিশ্বনাথ পাণ্ডব সহ একাধিক কাউন্সিলর সেই মিছিলে হাঁটলেন।
প্রসঙ্গত, ২০২২ এর পৌর নির্বাচনে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ২৫ আসন বিশিষ্ট মেদিনীপুর পৌরসভার ওই ওয়ার্ডে (১৪ নং) তৃণমূল প্রার্থী সংঘমিত্রা পাল’কে হারিয়েই কাউন্সিলর হয়েছিলেন নির্দল প্রার্থী অর্পিতা রায় নায়েক। উল্লেখ্য যে, এর আগে ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর ছিলেন তাঁর স্বামী বিশ্বেশ্বর নায়েক। ২০২২ সালে আসনটি মহিলা সংরক্ষিত হওয়ার পর তৃণমূলের প্রথম প্রার্থী তালিকায় নাম এসেছিল বিশ্বেশ্বর নায়েকের স্ত্রী অর্পিতা রায় নায়েকেরই। তবে, ঘন্টাখানেকের মধ্যেই যে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা পাঠানো হয় রাজ্য তৃণমূলের তরফে, সেখানে দেখা যায়, ১৪ নং ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে নাম রয়েছে সংঘমিত্রা পালের। এরপরই, নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় নায়েক দম্পতির তরফে। সেই ‘অপরাধে’ নায়েক দম্পতিকে ৬ বছরের জন্য বহিষ্কারও করা হয় রাজ্য তৃণমূলের তরফে। তবে, সম্প্রতি মেদিনীপুর পৌরসভায় চেয়ারম্যান গোষ্ঠী ও চেয়ারম্যান বিরোধী গোষ্ঠীর যে ‘উত্তেজনাপূর্ণ’ লড়াই শুরু হয়েছে, তাতে অর্পিতাকে ‘দলে টানতে’ মরিয়া চেয়ারম্যান গোষ্ঠী! আর সেজন্যই, এর আগে মেদিনীপুরের বিধায়ক জুন মালিয়া’র সঙ্গে একমঞ্চে থাকা থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান সৌমেন খানের এই মন্তব্য বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। উল্লেখ্য যে, ২৫ আসন বিশিষ্ট মেদিনীপুর পৌরসভায় তৃণমূলের কাউন্সিলর ২০ জন। তাঁদের মধ্যে শহর সভাপতি তথা ১৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিশ্বনাথ পাণ্ডব সহ ১১ জন ইতিমধ্যে চেয়ারম্যান সৌমেন খানের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করে চিঠি পাঠিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তবে, মেদিনীপুরের বিধায়ক জুন মালিয়া যদিও বরাবরের মতোই সৌমেন খানের পক্ষে ব্যাট ধরে কড়া ডিফেন্স থেকে শুরু করে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করেছেন এই বিষয়েও। সপ্তাহ খানেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, “মেদিনীপুর পৌরসভা যেমন চলছে তেমনই চলবে। বরং কেউ দলবিরোধী কাজ করলে তার বিরুদ্ধে শীর্ষ নেতৃত্ব ব্যবস্থা নেবে।” কিন্তু, এবার যেভাবে তৃণমূলেরই চেয়ারম্যান-কে দল ও পুলিশের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মন্তব্য করতে শোনা গেল, তা নিয়ে অবশ্য বিধায়কের প্রতিক্রিয়া মেলেনি! ভিডিওটি ‘আসল নয়’ বলে দাবি করেছেন সৌমেন খান।
জানা যায়, রবিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) অর্থাৎ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেশপুরের সভার ঠিক পরের দিনই সন্ধ্যা নাগাদ মেদিনীপুর পৌরসভার ১৪ নং ওয়ার্ডের তালপুকুর এলাকায় একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সৌমেন খান বলেন, “এই ওয়ার্ডের নির্দল কাউন্সিলর অর্পিতা রায় নায়েককে হারানোর জন্য পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগানো থেকে শুরু করে অনেক রকম চক্রান্ত করেছিল। শুধুমাত্র আপনারা পাশে থেকে অর্পিতাকে রক্ষা করেছেন। এমনকি বাইরে থেকে মস্তান নিয়ে এসে বোনেদের ভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু, তাতেও অর্পিতা রায় নায়েককে হারাতে পারেনি! এই কথাটা বলব বলেই আপনাদের কাছে এসেছি।” বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরই ১৪ নং ওয়ার্ড তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে মঙ্গলবার বিকেলে একটি ধিক্কার মিছিল করা হয়। যেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের ‘পরাজিত প্রার্থী’ সংঘমিত্রা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শহর তৃণমূলের সভাপতি তথা ১৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিশ্বনাথ পাণ্ডব, শহর মহিলা তৃণমূলের সভাপতি তথা ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মৌ রায়, ৬ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ডাঃ গোলোক বিহারী মাজি, ১১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর লিপি বিষই, ১৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোজাম্মেল হোসেন, ২০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রতিমা দে সহ তাঁদের গোষ্ঠীর (চেয়ারম্যান বিরোধী গোষ্ঠীর) অন্যান্য কাউন্সিলররা। এই বিষয়ে ১৪ নং ওয়ার্ডের ‘পরাজিত’ তৃণমূল প্রার্থী সঙ্ঘমিত্রা পাল বলেন, “পৌরপ্রধান তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড হওয়া কাউন্সিলার অর্পিতা রায় নায়েককে পাশে বসিয়ে দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন। তৃণমূল কর্মীদের গুন্ডা মস্তান বলেছেন। উনি কোন দল করেন, উনি সেটা পরিষ্কার করুন। নির্বাচনে আমাকে হারানোর পেছনে যে দলেরই একাংশ ছিলেন, সেটা উনি পরিস্কার দিয়েছেন যে কারা ছিল।” অন্যদিকে, পৌরপ্রধান সৌমেন খানের এই মন্তব্যের পর মেদিনীপুর জেলা তৃণমূল সভাপতি সুজয় হাজরা জানান, “মেদিনীপুর পৌর নির্বাচনে কোনোদিন শহরের কোথাও সন্ত্রাস হয়নি। যতগুলি নির্বাচন হয়েছে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। চেয়ারম্যান সৌমেন খানের কোন শারীরিক বা মানসিক সমস্যা হচ্ছে কিনা, বা তৃণমূলে নীতি আদর্শের সঙ্গে উনি একাত্ম হতে পারছেন কি না, তা দলকে আলোচনা করে দেখতে হবে।” তবে, বিষয়টি রাজ্য নেতৃত্বকেও জানানো হবে বলেই জানিয়েছেন সুজয় হাজরা। এদিকে, ওই ভিডিওটি আসল নয় বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান সৌমেন খান। তাঁর মতে, “আমি কখনোই ওই ধরনের কথা বলতে পারিনা। আমি বলেছি বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীদের চক্রান্ত রুখে দিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। আসল ভিডিওটি সামনে আনা দরকার!”