দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ২৩ নভেম্বর: “আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল….!” যার প্রতিটি স্পন্দনে আমাদের বেঁচে থাকা, জাগতিক সুখ-দুঃখ-আনন্দ অনুভব; তার ‘অপার-রহস্য’ ক’জনই বা উপলব্ধি করতে পেরেছেন! কবির বাণীতে মানব-হৃদয়ের মর্মকথা বারে বারে ফুটে উঠেছে ঠিকই, তবে হৃদপিন্ডের আনবিক-গঠনের ‘রহস্য’ বছরের পর বছর ধরে বিজ্ঞানীদের কাছে অধরাই থেকে গেছে। সেই রহস্যেরও সমাধান করলেন এক বাঙালিই! তিনি তরুণ বাঙালি বিজ্ঞানী তথা জঙ্গলমহলের ‘ভূমিপুত্র’ ও আইআইটি খড়্গপুরের (IIT Kharagpur) প্রাক্তনী ড. দেবব্রত দত্ত (Dr. Debabrata Dutta)। যে হৃদস্পন্দন আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, প্রতি মুহূর্তে সারা শরীরে রক্ত পাম্প করার জন্যই আমরা সেই হৃদস্পন্দনের ‘লাব ডাব’ ধ্বনি অনুভব করি। স্বাভাবিক কারণেই হৃদবিজ্ঞানীরা হৃদযন্ত্রের এই সংকোচন ও প্রসারণের (বা, লাব ডাব ধ্বনির) আণবিক পদ্ধতি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে চলেছেন যুগ যুগ ধরে। বিগত ৬০ বছরের এই রহস্যের সমাধান করলেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস মেডিকেল স্কুলে গবেষণারত বাঙালি বিজ্ঞানী ড: দেবব্রত দত্ত ও তাঁর সহকারী গবেষকেরা।
প্রসঙ্গত, হৃদ-বিজ্ঞানীদের মতে, অ্যাক্টিন ফিলামেন্ট (Actin Filament) ও মায়োসিন ফিলামেন্ট (Myosin Filament) নামক প্রোটিনের একে অপরের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়াই হল এই ‘লাব ডাব’ ধ্বনির অন্যতম কারণ। অ্যাক্টিন ফিলামেন্টের আণবিক গঠন বিজ্ঞানীদের জানা থাকলেও, মায়োসিন ফিলামেন্টের ‘আণবিক গঠন’ ছিল অজানা। বিভিন্ন হৃদরোগের কারণ খুঁজে বের করা থেকে শুরু করে, ওষুধ আবিষ্কারের প্রেক্ষাপটে এর আণবিক গঠন জানা বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল খুবই জরুরি একটি বিষয়। বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের হৃদপিন্ডের মায়োসিন ফিলামেন্ট যে কিভাবে আণবিক স্তরে কাজ করে এবং হৃদরোগে তার গঠনের কি পরিবর্তন হয়, তা নিয়ে হৃদবিজ্ঞানী ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা ধন্ধের মধ্যে ছিলেন। সেই রহস্যেরই সমাধান করলেন আইআইটি খড়্গপুরের (IIT Kharagpur) প্রাক্তনী দেবব্রত সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার’ এ প্রকাশিত তাঁদের এই গবেষণা বিজ্ঞানী মহলে সাড়া ফেলেছে।
‘নেচার’ এর আন্তর্জাতিক নিউস ডিপার্টমেন্ট ‘নেচার নিউস এন্ড ভিউস’ এও প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের এই আবিষ্কার। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি cryo-ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপি এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর সহায়তায় মানুষের হৃদপিন্ড থেকে বের করা এই মায়োসিন ফিলামেন্ট এর গঠন আবিষ্কার করেছেন ড: দেবব্রত দত্ত ও তাঁর সহ গবেষকরা। এটি মায়োসিন, টাইতিন এবং মায়োসিন বাইন্ডিং প্রোটিন সি- এর একটি অভূতপূর্ব কমপ্লেক্স আর্কিটেকচার বলে জানিয়েছেন জঙ্গলমহল বাঁকুড়ার ‘ভূমিপুত্র’ দেবব্রত। উল্লেখ্য যে, বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজিয়েট স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর দেবব্রত কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে রসায়নে সাম্মানিক স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। প্রথম থেকেই বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন দেবব্রত। দেশের প্রযুক্তিবিদ্যার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান আইআইটি খড়্গপুর (IIT Kharagpur)- এ বায়োটেকনোলজির ওপর গবেষণা করার মধ্য দিয়ে দেবব্রত সেই লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যান। ২০১৯ সালে আইআইটি খড়্গপুর থেকে পিএইচডি (Phd) ডিগ্রী লাভ করে দেবব্রত আমেরিকায় রওনা দেন অত্যাধুনিক গবেষণার উদ্দেশ্যে। প্রথমে আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ’ এ গবেষণা করার পর ‘ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেট্স মেডিকেল স্কুলে’ রেডিওলজি বিভাগে ড: রজার ক্রেইগের ল্যাবরেটরিতে যোগদান করেন। সেখান থেকেই শুরু হয় এই অভিযান। ‘বাঙালি বিজ্ঞানী’ দেবব্রত দত্তের এই গবেষণা হৃদরোগের আণবিক কারণ নির্ধারণে এবং ওষুধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এক নবদিগন্ত উন্মোচন করতে চলেছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক মহল। (Edited by Maniraj Ghosh)