দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, কলকাতা, ৬ এপ্রিল: আবারও এক নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী থাকলো কলকাতায় হাই কোর্টের ১৭ নং আদালত কক্ষ (বা, এজলাস)! জেলবন্দী (প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি) প্রাক্তন পর্ষদ (প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ) সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকে মাত্র ঘন্টাখানেকের নোটিশে হাজির করা হলো কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে (১৭ নং রুমে)। সিবিআই বা ইডি নয়, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত প্রাক্তন পর্ষদ কর্তাকে প্রশ্ন করলেন স্বয়ং বিচারপতি। ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের (Indian Evidence Act) ১৬৫ নং ধারা প্রয়োগ করে মানিক ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন বিচারপতি। যা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে নিঃসন্দেহে এক নজিরবিহীন ঘটনা বলে কলকাতা হাইকোর্টের প্রায় সমস্ত আইনজীবীরাই স্বীকার করেছেন। আর, সেই নজিরবিহীন ঘটনা বা জিজ্ঞাসাবাদের পরতে পরতে যেমন ছিল নাটকীয়তা, ঠিক তেমনই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আরো এক নাটক দেখলো ভরা এজলাস! যাঁর বিরুদ্ধে হাজার হাজার যোগ্য চাকরিপ্রার্থীকে বঞ্চিত করে, ‘বেনজির’ দুর্নীতি করার অভিযোগ; সেই মানিক ভট্টাচার্য হাতজোড় করে বিচারপতির উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনিই বিচার করুন। সত্য সামনে আসুক। সত্য সুন্দর।” এরপর, বিচারপতিও কিছুটা শ্লেষের সুরে বলেন, “দশচক্রে ভগবান ভূত। এই মানিক ভট্টাচার্য-ই আমাদের ডেপুটি শেরিফের শিক্ষক ছিলেন!”
প্রসঙ্গত, বুধবার বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে ২০১৪ সালের টেট থেকে হওয়া ২০১৬ সালের ৪২,৫০০ প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ‘বেনজির’ দুর্নীতির অভিযোগে করা একটি মামলার শুনানি ছিল। মামলাকারীদের আইনজীবী (তথা, বিজেপি মুখপাত্র) তরুণ জ্যোতি তেওয়ারির অভিযোগ ছিল, অ্যাপটিটিউড টেস্ট ছাড়াই নিয়োগ হয়েছে। যাঁদের টেট এবং একাডেমিকে নাম্বার কম তাঁদেরই অ্যাপটিটিউড টেস্ট এবং ইন্টারভিউতে ৯০ শতাংশ বা তার বেশি নাম্বার (১০ এর মধ্যে ৯ বা সাড়ে ৯) দিয়ে নিয়োগ করা হয়েছে। আইনজীবী তা প্রমাণ সহকারে দেখিয়েও দেন। এরপরই, মানিক ভট্টাচার্যকে এই বিষয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন বিচারপতি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বিকেল তিনটা নাগাদ কলকাতা হাইকোর্টের ১৭ নং আদালত কক্ষে শুরু হয় সেই সওয়াল-জবাব। ৯-টি প্রশ্ন করেন বিচারপতি। তাঁর মতো করেই ‘উত্তর’ দেন মানিক ভট্টাচার্য। বলা ভালো, উত্তরের থেকে বেশি ‘অজুহাত’-ই দিয়েছেন।
প্রশ্ন ১. ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কি কোন সিলেকশন কমিটি তৈরি করা হয়েছিল?
মানিক: হ্যাঁ, বোর্ড (প্রাইমারি বোর্ড বা পর্ষদ) এর তরফে সিলেকশন কমিটি তৈরি করা হয়েছিল।
২. ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ার ফল কে প্রকাশ করেছিল?
মানিক: এটা আমি বলতে পারি না। বিশেষ করে এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছেই বোধগম্য নয়। নিয়োগ প্রক্রিয়ার মোট নম্বর বিভিন্ন বিভাগ একসঙ্গে মিলে তৈরি করে।
৩. বাইরের কোনও সংস্থাকে রেজ়াল্ট প্রস্তুত করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল?
মানিক: এই পুরো প্রক্রিয়া পর্ষদ পরিচালনা করেছে। তবে হ্যাঁ, বিধি মেনে ৪ নং ধারা ৫ নং উপধারা (সি) মেনে একটি সংস্থাকে নিয়োগ করা হয়েছিল।
৪. এই বিষয়ে অভিজ্ঞ (স্পেশালাইজড) কোনো সংস্থা?
মানিক: হ্যাঁ।
৫. নাম কি সেই সংস্থার?
মানিক: এখন তার নাম স্মরণে নেই।
৬. এস বসু রায় অ্যান্ড কোম্পানি নামে কোনও সংস্থার নাম শুনেছেন?
মানিক: হ্যাঁ, ওই ধরনের নাম শুনেছি।
৭. সভাপতি হিসাবে আপনার সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা কি ঠিক? অ্যাপটিটিউড টেস্ট নেওয়া হয়েছিল?
মানিক: অ্যাপ্টটিটিউড টেস্ট নেওয়া হয়েছিল। তখন কেউ কোনও অভিযোগ করেনি। এমন কোনও রিপোর্ট আমার কাছে আসেনি।
৮. ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ নীতি মানা হয়েছিল— এটা আপনি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন?
মানিক: যত দূর মনে পড়ছে আইন অনুযায়ী হয়েছিল।
৯. প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় ইডি ও সিবিআই এর জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া, ব্যক্তিগতভাবে আপনার বিরুদ্ধে গিয়েছে, এমন কিছু হয়েছে?
মানিক: না, তা হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা হয়নি।
এরপরই, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ঠিক আছে। এখন আমার আর কিছু জানার নেই। আপনি যে বয়ান দিয়েছেন তাতে স্বাক্ষর করে চলে যাবেন।” তবে, একান্তে ১০-১৫ মিনিট মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলেন বলে আদালত সূত্রে জানা যায়। মানিক সবশেষে বলেন, “এই সংক্রান্ত যে কোনও মামলায় দরকার পড়লেই আমাকে ডেকে পাঠাবেন। ১৫ মিনিট আগে বললেই হবে। আমি চলে আসব। পরে আমার বিরুদ্ধে যাই পদক্ষেপ করা হোক, আমি মেনে নেব। আমি সত্যিটাই বলতে চাই। সত্য সামনে আসুক। সত্য সুন্দর।”