দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১১ সেপ্টেম্বর: মুখ্যমন্ত্রীর পশ্চিম মেদিনীপুর সফরের আগেই কলকাতা হাইকোর্টের কড়া পদক্ষেপে মুখ পুড়লো জেলা পুলিশের! নির্যাতিতা মহিলার অভিযোগ না নেওয়ায় এবং নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও ঘটনার দিনের (১১ আগস্ট, ২০২২) সিসিটিভি ফুটেজ কলকাতা হাইকোর্টের হাতে তুলে না দেওয়ায়, গত বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি থানার ওসি এবং জেলা পুলিশ সুপার (এসপি)-এর বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ জারি করেছে কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চ। আদালত সূত্রে জানা গেছে, গণধর্ষণের শিকার হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর ব্লকের আনন্দপুর থানার বাসিন্দা এক গৃহবধূ তাঁর স্বামীকে নিয়ে থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে, ফিরিয়ে দেন পুলিশ আধিকারিকরা। এমনকি, মেদিনীপুর জেলা আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর-ও হেলদোল দেখা যায়নি। জেলা পুলিশ সুপার বা SP’র দ্বারস্থ হয়েও লাভ হয়নি। শেষমেশ কলকাতা হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন নির্যাতিতা মহিলা। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজশেখর মান্থা’র পর্যবেক্ষণ আর কড়া নির্দেশে অবশেষে সঠিক বিচারের আশায় বুক বেঁধেছেন নির্যাতিতা ওই গৃহবধূ ও তাঁর স্বামী। একইসঙ্গে আনন্দপুর থানার ওসি (সুবীর মাজি) এবং জেলা পুলিশ সুপার (দীনেশ কুমার)- এর বিরুদ্ধে রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে তদন্ত করে রিপোর্ট পেশ করার নির্দেশ জারি করেছেন বিচারপতি। রাজ্যের‌ স্বরাষ্ট্র সচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশও দিয়েছেন। অভিযোগ না নেওয়া থেকে শুরু করে সিসিটিভি ফুটেজ সরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আনন্দপুর থানা তথা জেলা পুলিশের বিরুদ্ধে। গোটা ঘটনায় সিআইডি তদন্তের পরামর্শ দিয়ে, আগামী ২২ সেপ্টেম্বর পুনরায় মামলার শুনানির দিন ধার্য করেছেন বিচারপতি রাজশেখর মান্থা।

thebengalpost.net
নির্যাতিতা ও তাঁর স্বামী:

ঘটনাক্রমে জানা যায়, আনন্দপুর থানার বাসিন্দা এক যুবক আলু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় চন্দ্রকোণা রোডেও একটি বাড়ি তৈরি করেন। বিয়ের পর স্ত্রী-কে নিয়ে দু’জায়গাতেই থাকতেন। হঠাৎ গত ২১ এপ্রিল (২০২২) টাকা-পয়সার দাবি করে চন্দ্রকোণা রোড এলাকার তিন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁদের মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং চন্দ্রকোণা রোডের ওই বাড়ি দখল করে। যুবকের অভিযোগ অনুযায়ী, এই বিষয়ে চন্দ্রকোণা রোড পুলিশ ফাঁড়ি তাঁদের অভিযোগ না নেওয়ায় গড়বেতা থানায় লিখিত অভিযোগ (জিডি) করেন তিনি। তারপর মেদিনীপুর আদালতের শরণাপন্ন হলে কোর্ট বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেয় প্রভাবশালী ওই তিনজনকে। কিন্তু, সেই নির্দেশ তারা উপেক্ষা করে। এমনকি, ১৪৪ ধারা থাকা সত্ত্বেও, বেআইনিভাবে ওই বাড়িতে নির্মাণ কার্য-ও চালিয়ে যায়। এরপর, জেলা পুলিশ সুপারের দপ্তর থেকে বিডিও, বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ জানান অত্যাচারিত যুবক। এরপরই, তাঁর সাথে এবং তাঁর স্ত্রী’র সাথে ঘটে যায় হাড় হিম করা ঘটনা! যুবকের বর্ণনা অনুযায়ী, “চন্দ্রকোণা রোডের ওই তিন প্রভাবশালী ব্যক্তি, যথাক্রমে- জয়ন্ত ঘোষ, মানস ঘোষ, অরূপ ভুঁইয়া হঠাৎ একদিন ফোন করে আমাকে বলেন, যা হয়েছে হয়েছে, একদিন রোডে তোমার বাড়িতে এসো, সব মিটিয়ে নেব। এরপর, আমি আর আমার স্ত্রী গত ১১ আগস্ট (২০২২) চন্দ্রকোণা রোডের বাড়িতে যাই। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হওয়ার পর, আমি বলি ঠিক আছে, আমি হোটেলে থেকে খেয়ে আসি, ফিরে এসে বাকি কথা হবে। ওরাও বলে ঠিক আছে। ওরা চলে যাওয়ার পর, আমি স্ত্রী-কে আমাদের বাড়িতে বসিয়ে দিয়ে খেতে যাই। ওর (স্ত্রী’র) জন্য খাওয়ার নিয়ে আসার কথা বলে, ওকে দরজা লাগিয়ে দিতে বলি এবং আমি বাইরে বেরিয়ে যাই। তার মধ্যেই ওরা তিনজন ফিরে এসে, আমার স্ত্রী-কে ধর্ষণ করে! আমি যখন খাওয়ার নিয়ে পৌঁছই তখন পালিয়ে যায়। এরপর, পরিস্থিতি কিছুটা সামলে, আমরা ভয়-আতঙ্ক সঙ্গে নিয়েই যখন চন্দ্রকোণা রোড পুলিশ ফাঁড়ির দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই; ওরা ফিরে এসে আমার গলায় ছুরি বসিয়ে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে যায়। এরপরই আমরা ওখান থেকে পালিয়ে যাই আনন্দপুরের উদ্দেশ্যে। শালবনী পেরোনোর পর, ফের জঙ্গলরাস্তায় আমাদের পথ আটকে মারধর করা হয় এবং হুমকি দেওয়া হয়। সেই অবস্থাতেই আমরা ওইদিন আনন্দপুর থানায় যাই। কিন্তু, সব শুনে পুলিশ ধর্ষণের অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে এবং বলে চন্দ্রকোনা রোড বা গড়বেতা থানায় ওই অভিযোগ জানাতে অথবা কোর্টে অভিযোগ জানাতে!”

thebengalpost.net
বিজ্ঞাপন (Advertisement):

এরপর, গত ১৬ আগস্ট মেদিনীপুর জেলা আদালতের শরণাপন্ন হন নির্যাতনের শিকার ওই যুবক ও তাঁর স্ত্রী। আদালতের নির্দেশ দেয় এফআইআর নেওয়ার জন্য। ১৭ আগস্ট আনন্দপুর থানা বলে, ধর্ষণের অভিযোগ নেওয়া হবেনা, শুধু মারধরের অভিযোগ নেওয়া হবে। এরপর, জেলা পুলিশ সুপার-কে জানিয়েও কাজ না হওয়ায়, অবশেষে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন তাঁরা। ধর্ষিতা ও নির্যাতিতা গৃহবধূ মামলা দায়ের করেন বিচারপতি রাজশেখর মান্থা’র এজলাসে। গত ৬ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) শুনানি হলে, বিচারপতি মান্থা আনন্দপুর থানার কাছে ১১ আগস্টের সিসিটিভি ফুটেজ (যেদিন তাঁরা অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন) এবং জেলা পুলিশ সুপারের রিপোর্ট চেয়ে পাঠান। নজিরবিহীন ভাবে, ওই দিন (৬ সেপ্টেম্বর) দুপুর ৩ টা ৫ মিনিটে আনন্দপুর থানা লিখিত অভিযোগ বা FIR নথিবদ্ধ করে! যদিও, অভিযুক্তদের এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। অন্যদিকে, বিচারপতি মান্থা’র নির্দেশ অনুযায়ী যে সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশ তুলে দেয়, সেখানে ৪ আগস্ট পর্যন্ত সমস্ত ফুটেজ থাকলেও, তার পরের (অর্থাৎ ১১ আগস্ট বা তার পরের ফুটেজ) কোনো ফুটেজ দেওয়া হয়নি! বলা হয়, ৪ আগস্ট থেকে সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে না! এরপরই, সমস্ত বিষয় জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় বিচারপতি’র কাছে। তাই, ৮ সেপ্টেম্বরের শুনানিতে, আনন্দপুর থানার ওসি এবং জেলা পুলিশ সুপার-এর এই ধরনের ‘কাজকর্মের’ বিরুদ্ধে বিচারপতি মান্থা গর্জে ওঠেন। ওসি’র অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে এবং তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেওয়ায় এসপি’র বিরুদ্ধে তিনি অবিলম্বে তদন্ত শুরু করার বা সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রসচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে। প্রয়োজনে গোটা ঘটনার তদন্ত সিআইডির হাতে তুলে দেওয়ার কথাও বলেন। ডিজি এই বিষয়ে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন, তা ২২ সেপ্টেম্বর রিপোর্ট আকারে পেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। গোটা ঘটনায় বেশ চাপের মুখে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ!

thebengalpost.net
বিজ্ঞাপন (Advertisement) :