দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, কলকাতা, ১৫ অক্টোবর: একজন শ্রী শ্রী অনুকূল ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত। তার সঙ্গে আবার শাসকদলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্লক সভাপতি। অন্যজন, আবার নিজের এলাকায় ‘নাক উঁচু’ ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সঙ্গে শাসকদলের শীর্ষ স্তরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তো ছিলই। গত কয়েকবছরে অবশ্য দু’জনের এক এবং একমাত্র পরিচয় হয়ে উঠেছিল প্রাইমারি বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মানিক ভট্টাচার্যের বাম হাত আর ডান হাত! দু’জনই একাধিক শিক্ষক শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (বিএড কলেজ এবং ডি এল এড কলেজ) মালিক ছিলেন। ছিলেন এই সমস্ত কলেজের ইউনিয়নের মাথা। তাঁদের কথাই ছিলো শেষ কথা। তাঁদেরকে টাকা না দিয়ে, ডি.এল.এড কলেজের কোনো ফাইল নড়তোনা! এমনকি, নতুন ডিএলএড কলেজ করতে গেলেও এঁদের অনুমতি নিয়েই করতে হতো। প্রাইমারিতে হাজার হাজার অযোগ্যদের নিয়োগ থেকে শুরু করে ব্যাকডেটে (যে সালের প্রয়োজন) সার্টিফিকেট তৈরি করে দেওয়া কিংবা নতুন কলেজের অনুমোদন, শিক্ষক বদলি- প্রভৃতি প্রাইমারি সংক্রান্ত সবকিছুই গত ১০ বছরে যে দু’জনের মাধ্যমে মানিক-চাঁদ সম্পন্ন করতেন সেই বিভাস চন্দ্র অধিকারী আর তাপস মণ্ডল-ই এবার ইডি’র র্যাডারে। বিভিন্ন শিক্ষক শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের মালিকরা একযোগে বলছেন, “মৌচাকে ঢিল পড়েছে! আর, কিছু করার নেই।” অর্থাৎ, সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পাওয়া, ব্যাকডেটের সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি পাওয়া, টেট ফেল করে বা টেটে না বসেই চাকরি পাওয়াদের এবার চাকরি যাওয়া নাকি শুধুই সময়ের অপেক্ষা! আর, সংখ্যাটা নাকি কয়েক হাজার। কারণ, শনিবার সকাল থেকে ইডি তাঁদের আস্তানা বা ডেরা গুলিতে হানা দিয়ে অসংখ্য নথি, হার্ড ডিস্ক প্রভৃতি উদ্ধার করেছে। এমনকি, পুজোর আগেই অর্থাৎ মানিক ভট্টাচার্যের গ্রেফতারি নিয়ে যখন জোর জল্পনা চলছিল, সেই সময়ই ট্রাঙ্ক ট্রাঙ্ক টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও জানতে পেরেছেন ইডি আধিকারিকরা।
শনিবার, আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি ফ্ল্যাটে হানা দিয়ে সেটি সিল করে দেন ইডি আধিকারিকরা। ইডি সূ্ত্রে জানা গিয়েছে, এই ফ্ল্যাটটির মালিক বিভাস চন্দ্র অধিকারী। একসময় ফ্ল্যাটটিতে বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের নাম (নেমপ্লেট) থাকলেও, বর্তমানে সেখানে লেখা “ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সৎসঙ্গ মিশন সাধনাপীঠ”। এই ফ্ল্যাটেই চলতো কোটি কোটি টাকার কারবার। অযোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে যে লক্ষ লক্ষ টাকা (৭ থেকে ১০ লক্ষ) নেওয়া হতো, তা ট্রাঙ্কে করে সন্ধ্যার পর পৌঁছে যেত এই ফ্ল্যাটে। বিভাসের এক প্রতিবেশী জানিয়েছেন, ফ্ল্যাটটিতে অ়জ্ঞাতপরিচয় মানুষজনের আনাগোনা ছিল। ফ্ল্যাটে যাঁরা আসতেন, তাঁরা মূলত রাতের দিকে আসতেন! আবাসনের বাসিন্দাদের দাবি, খুব বড় বড় ব্যাগ নিয়ে ফ্ল্যাটে আসতেন বিভাস। বিভাসের সঙ্গে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীরা থাকত বলেও জানিয়েছেন তাঁরা। বীরভূমের নলহাটি (২) ব্লক তৃণমূলের সভাপতি এই বিভাস অধিকারী মানিক ভট্টাচার্যের গ্রেফতারির পর-ই পদত্যাগ করেছেন বলে সূত্রের খবর। শনিবার তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বীরভূম থেকে জানিয়েছেন, “এসব কথা সিপিআইএমের নেতারা বলছেন। ওই ফ্ল্যাটে ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের শিষ্যরা অর্থাৎ গুরুভাইরা আসতেন। বিভিন্ন স্থান থেকে চিকিৎসার প্রয়োজন সহ নানা কাজে তাঁরা কলকাতায় আসতেন, তাই রাতেও মাঝেমধ্যে তাঁদের থাকতে হতো।” বিভাস এদিন, মুখ কাঁচুমাচু করে “তদন্তের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত” বলে জানালেও, বিভিন্ন কলেজ মালিকরা একযোগে বলছেন, “মানিক বাবুর ডান হাত ছিলেন বিভাস অধিকারী। তাঁর মাধ্যমেই চলতো দুর্নীতির বড়সড়ো কারবার!” এবার, সেই রহস্য উদ্ধারের পথে ইডি এবং সিবিআই।
অন্যদিকে, শনিবার সেক্টর ফাইভ সংলগ্ন মহিষবাথানের একটি অফিসেও তল্লাশি চালায় ইডি। অফিসের গেট বন্ধ থাকার কারণে তালা ভেঙে তারা অফিসের ভেতরে যায়। তখনই জানা যায়, সেই অফিসের মালিক তাপস মন্ডল(Tapas Mondal)। এই ব্যক্তির সাথে মানিক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠতা আছে। তিন ঘন্টায় ধরে তল্লাশি চালানো হয় মহিষবাথানের প্রাইভেটে এজেন্সির অফিসে। ইডি সূত্রের খবর ,সেই অফিস থেকে উদ্ধার হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য । উদ্ধার হয়েছে মানিক ভট্টাচার্য এবং তাপস মন্ডলের ছবি। এলাকা সূত্রের খবর, এই অফিসে মানিকবাবু আসতেন এবং রাতভর এই অফিস খোলা থাকতো। এই অফিসে প্রাথমিক শিক্ষক হওয়ার ট্রেনিং দেওয়া হত। তাপস মন্ডল ৩৬ মাসের ভাড়ায় নিয়েছিলেন এই অফিস। মহিষবাথানের ফ্ল্যাটে গত পাঁচ মাসের ভাড়া বাকি বলেও জানা গেছে! এরপর, ইডি আধিকারিকরা শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের একটি বাড়িতে হানা দেন। ইডি সূত্রের খবর, ওই বহুতলের মালিক শৈবাল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ওই বাড়ির একটি ঘর ভাড়া নিয়ে জনৈক তাপস মণ্ডল ১৯৯২-৯৩ সালে মিনার্ভা এডুকেশনাল অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি নামে একটি কোচিং সেন্টার চালাতেন। পরে একটি ঝামেলার কারণে তাঁকে সেই বাড়ি থেকে উঠে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ইডি মনে করছে এই একই নামের মহিষবাথানের ট্রেনিং সেন্টারটির মালিকও এই তাপস মণ্ডলই। শনিবার শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের বাড়ির মালিক জানতে পারেন, একাধিক জায়গায় নিজের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ওই বাড়ির নাম করতেন তাপস। সেই সূত্রেই শনিবার ওই বাড়িতে হানা দেন ইডি আধিকারিকরা। বারাসতে তাপস মণ্ডলের বাড়িতেও এদিন হানা দেন তদন্তকারীরা। এখানের এক প্রতিবেশী বলেন, “উনি পাড়ায় কারও সঙ্গে মেশামেশা করতেন না। কারণ পাড়ার সবাই ‘অভদ্র’, আর উনি একাই ‘ভদ্রলোক’! উনি একাই শিক্ষিত আর বাকিরা মূর্খ। শুনেছি উনি বিভিন্ন কলেজের সঙ্গে যুক্ত আছেন। বিভিন্ন কলেজে লাইসেন্স পাইয়ে দিতেন টাকার বিনিয়মে। আজ সকাল থেকেই থেকেই দেখছি তাঁর বাড়িতে ED তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে।” সবমিলিয়ে, বিভাস ও তাপস-কে ঘিরেই এখন মানিকের প্রাইমারি-কেলেঙ্কারির রহস্য উদ্ধারে আশাবাদী ইডি-সিবিআই।