মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৪ মে:ইনফ্লুয়েঞ্জা (Influenza), আর এস ভি (RSV- Respiratory Syncytial Virus) সহ বিভিন্ন ভাইরাসের আক্রমণে ৬ মাস অবধি শিশুদের জ্বর, শ্বাসকষ্ট এবং মৃত্যুর হার নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক। অপরদিকে, সদ্যজাত (Neonatal) বা ৬ মাস পর্যন্ত শিশুদের এত রকমের টিকা প্রদানের অনুমতি নেই। সর্বোপরি, তা ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারে বলে স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ-দের মত। সেক্ষেত্রে, শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বা ভাইরাসের প্রকোপে শ্বাসকষ্ট জনিত অসুখ রুখে দেওয়ার জন্য, গর্ভবতী বা অন্তঃসত্ত্বা-দের টিকাকরণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে আমেরিকা সহ বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোতে। কিন্তু, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে এখনও অবধি অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের বা গর্ভাবস্থায় টিকাকরণের বিষয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। সরকারের (কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক) পক্ষ থেকেও এদেশে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের শুধুমাত্র ডিপথেরিয়া-টিটেনাস-হুপিং কাশি’র টিকা দেওয়া হয়ে। তবে, অতিমারীর পর কোভিড ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে। সেই ছাড়পত্র-ও দেওয়া হয়েছে ICMR এবং স্বাস্থ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে। কিন্তু, গবেষণায় দেখা গেছে, ৬ মাস পর্যন্ত শিশুদের ক্ষেত্রে সবথেকে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে যে ভাইরাসটি, সেটি হল- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। এছাড়াও, আরএসভি (Respiratory Syncytial Virus)’র মতো ভাইরাসগুলিও শ্বাসকষ্টের জন্য প্রবলভাবে দায়ী। এই সমস্ত ভাইরাসগুলো সদ্যজাতদের ফুসফুসে সরাসরি আক্রমণ করে শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা বাড়ায়। তা থেকে অনেক সময় মৃত্যুও হয়। তাই এবার, খড়্গপুর আইআইটি (IIT Kharagpur) এর SMST (School of Medical Science and Technology) এবং মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, শিশু বিভাগ এবং স্ত্রী ও প্রসূতি বিভাগের পক্ষ থেকে যৌথ গবেষণায় দেখা হবে, গর্ভবতী বা অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের (৩০ সপ্তাহের মাথায়) ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টিকাকরনের মধ্য দিয়ে ৬ মাস পর্যন্ত শিশুদের উপর ইনফ্লুয়েঞ্জার আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায় কিনা! জানানো হয়েছে, মেদিনীপুর মেডিক্যাল ও আইআইটি খড়্গপুরের SMST বিভাগের পক্ষ থেকে।

গবেষণার অংশ হিসেবে, ইতিমধ্যে ২০২১-এর নভেম্বর মাস থেকে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের উপর সমীক্ষা শুরু করা হয়েছে। তারপর টিকাকরণের উপর গবেষণা চালানো হবে বলে আইআইটি খড়্গপুর এবং মেদিনীপুর মেডিক্যালের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, ২০২১ এর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশজুড়ে যখন কোভিডের তৃতীয় ঢেউ চলছে, সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে অজানা জ্বরে শিশু মৃত্যুর হার বাড়ছিল। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালেও প্রতিদিন ৩০-৪০ জন করে শিশু জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হচ্ছিল। সেই সময়ই, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও আইআইটি খড়্গপুরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ থেকে গবেষণা চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছিল, ইনফ্লুয়েঞ্জা ছাড়া যে ভাইরাসটি এজন্য দায়ী, তা হল- আরএসভি বা আর এস ভাইরাস। সেই সময়ই, শ্বাসকষ্ট জনিত অসুখের জন্য দায়ী ইনফ্লুয়েঞ্জা, আরএসভি সহ এই ধরনের ভাইরাসের হাত থেকে সদ্যোজাত শিশু বা নবজাতকদের রক্ষা করার জন্য অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের টিকাকরণ করা যায় কিনা, তা নিয়ে গবেষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

thebengalpost.net
সাংবাদিক বৈঠক :

অবশেষে, ২০২১ এর নভেম্বর মাসে কেন্দ্র ও রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের ছাড়পত্র মিলেছে। যৌথভাবে সমীক্ষা ও গবেষণা শুরু করেছে আইআইটি খড়্গপুর এবং মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি, একটি যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে আইআইটি খড়্গপুরের SMST বিভাগের ড. সঙ্গীতা দাস ভট্টাচার্য, ড. টিলা খান, ড. রঞ্জন সৌরভ দাস- প্রমুখ এবং মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডাঃ পঞ্চানন কুন্ডু, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ পার্থসারথি সৎপতি, সহকারী অধ্যাপক ডাঃ সায়ন্তনী অ্যান্ডু, শিশু বিভাগের প্রধান ডাঃ তারাপদ ঘোষ এবং স্ত্রী ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক তথা সহকারী অধ্যাপক (Associate Professor) ডাঃ সব্যসাচী রায় প্রমুখ উপস্থিত হয়ে জানিয়েছেন- মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ, খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতাল, খড়্গপুর রেলওয়ে হাসপাতাল এবং আইআইটি খড়্গপুরের বি.সি. রায় হাসপাতালের মোট ১৬১ জন অন্তঃসত্ত্বা মহিলার ওপর সমীক্ষা শুরু করা হয়েছে। তাঁদের ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ওই ধরনের কোনো জ্বর হচ্ছে কিনা, হলে তা শিশুদের উপর কোন প্রভাব ফেলছে কিনা, ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত শিশুদের মায়ের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শারীরিক যত্ন কিভাবে নেওয়া হয়েছে, ডিপথেরিয়া-টিটেনাস-হুপিং কাশির টিকা তিনি নিয়েছেন কিনা- এই সমস্ত সমীক্ষা শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা। ধীরে ধীরে শহর ও গ্রামাঞ্চলের অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের উপরও চালানো হবে এই সমীক্ষা, এমনটাই জানিয়েছেন তাঁরা। এরপর, সেই রিপোর্ট কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের কাছে পাঠানো হবে। তারপর, ভারতেও অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকাকরণের প্রয়োজন আছে কিনা, সেই গুরুত্ব বিবেচনা করা হবে এই গবেষণায়। ড. সঙ্গীতা দাস ভট্টাচার্য এবং ডাঃ সব্যসাচী রায় এও জানিয়েছেন, বিদেশে ৩০ সপ্তাহের মাথায় অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকাকরণ করা হয়। এদেশেও বেসরকারিভাবে এই ধরনের টিকা নেওয়া যায় বলে জানিয়েছেন ডাঃ রায়। তবে, ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে, কোভিডের মতোই সরকারিভাবে এই ধরনের টিকাকরন করা হলে, তাতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি উপকৃত হবে বলে তাঁদের অভিমত। একইসঙ্গে, এর ফলে শিশুমৃত্যু কমতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে গবেষণায় উঠে এসেছে। কারণ, অন্তঃসত্ত্বা বা গর্ভবতী মায়ের টিকাকরণ হলে, সদ্যজাত শিশু’র দেহেও অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে ৬ মাস পর্যন্ত তাকে সুরক্ষা দেবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

thebengalpost.net
সাংবাদিক বৈঠকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ পঞ্চানন কুন্ডু সহ অন্যান্যরা :