মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২০ সেপ্টেম্বর: অজানা জ্বরের প্রকোপ বাড়ছে রাজ্যে। শেষ ৪ দিনে সরকারিভাবে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে ৭ জনের। এদিকে, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম প্রভৃতি জেলায় এখনও পর্যন্ত অজানা জ্বরের প্রকোপ দেখা না গেলেও, ভাইরাল ফিভার (Viral Fever) বা মরশুমি জ্বরের দাপট বাড়ছে। স্বীকার করছেন স্বাস্থ্য আধিকারিক থেকে শিশু চিকিৎসকরা। শুধু মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে এই মুহূর্তে জ্বর-সর্দি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি আছে মোট ২১৯ জন শিশু। এর মধ্যে, নবজাতকের সংখ্যা ১০২ জন, যাদের এস এন সি ইউ (SNCU)- তে রাখা হয়েছে। বাকিদের মধ্যে, ১০৫ জন শিশু সাধারণ পেডিয়াট্রিক্স বিভাগে থাকলেও, ১২ জন আছে পিকু (PICU- Pediatrics Intensive Care Unit)- তে। কোভিড আরটিপিসিআর (RT-PCR) রিপোর্ট সকলের ‘নেগেটিভ’ হলেও, বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসের (ইনফ্লুয়েঞ্জা, প্যারা ইনফ্লুয়েঞ্জা, আরসিভি প্রভৃতি) আক্রমণেই শিশুরা জ্বর-সর্দি-শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান ডাঃ তারাপদ ঘোষ। এই হার যে অন্যবারের তুলনায় দ্বিগুণ (বা, তার থেকেও বেশি), মানছেন তিনি। সোমবার তিনি বললেন, “অন্যবারের তুলনায় সংখ্যাটা অনেকটাই বেশি। কারণটা কি, তা এখনই বলা সম্ভব নয়, তবে এ নিয়ে আমরা গবেষণা শুরু করছি। তবে, যে সকল শিশুরা আসছে তাদের বেশিরভাগেরই অবস্থা বেশ গুরুতর! শ্বাসকষ্ট থাকছে অনেকেরই। অক্সিজেন ও ন্যাবু লাইজার প্রয়োগ করতে হচ্ছে। তবে, মৃত্যুর হার কম।”
এদিকে, গত ৭ দিনে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে একটি ৫ মাসের শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান ডাঃ তারাপদ ঘোষ। যদিও শিশু-টির মৃত্যুর প্রধান কারণ জটিল স্নায়ু রোগ, যার পোশাকি নাম- স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রপি (Spinal Muscular Atrophy)। এটি একটি দুরারোগ্য জন্মগত ত্রুটিজনিত (Genetic Disorder) রোগ। এই রোগে শিশু এমনিতেই চিকিৎসায় সাড়া দেয়না, সঙ্গে জ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জা যোগ হওয়ায় ভেন্টিলেশনে রেখেও শিশুটিকে বাঁচানো যায়নি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। শনিবার তার মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া, বাকি শিশুদের অনেকেই সুস্থ হয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। যারা চিকিৎসাধীন আছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগের শ্বাসকষ্ট আছে, অক্সিজেন চলছে, অনেকেই ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে ভর্তি আছে, তবে তা চিকিৎসা যোগ্য বলে জানিয়েছেন মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান। এই মুহূর্তে মেডিক্যালে ১৮০ টি শয্যায় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২২০ জন শিশু ভর্তি থাকছে। এ নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ পঞ্চানন কুন্ডু জানিয়েছেন, “আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আমাদের নতুন পেডিয়াট্রিক্স ওয়ার্ড চালু হয়ে গেলে ৫০ বেডের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট (২৫ টি জেনারেল ও ২৫ টি কোভিড) সহ ২৫০ টি শয্যা থাকবে।” এদিকে, শিশুদের কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও, শ্বাসকষ্ট দেখা যাচ্ছে; এজন্য যে ভাইরাসটিকে দায়ী করা হচ্ছে, সেটি হল- আর সি ভি (Respiratory Syncytial Virus)। এছাড়াও, সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় ২০ শতাংশের বেশি শিশু। সম্প্রতি, বিভাগীয় প্রধান ডাঃ পার্থসারথি সতপথি’র নেতৃত্বে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের পক্ষ থেকে এই পরীক্ষা করা হয়েছিল। রাজ্যের কাছে আরও ইনফ্লুয়েঞ্জা কিট চেয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ পঞ্চানন কুন্ডু। তবে, অন্যান্য জটিল ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং এম সি আই সি (Multi System Inflammatory Syndrome- Child) ও আছে বলে জানিয়েছেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ও বিভাগীয় প্রধান ডাঃ তারাপদ ঘোষ। এক্ষেত্রে, এই MSI-C যে কোভিড পরবর্তী বা পোস্ট কোভিড জনিত জটিল রোগ তা মানছেন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ দীপক মাসান্ত থেকে শুরু করে মেডিক্যাল কলেজের আধিকারিকরা। তবে, আরসিভি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে খুব শীঘ্রই মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ তথা আইএমএ (IMA- Indian Medical Association)’র প্রেসিডেন্ট ডাঃ তারাপদ ঘোষ এবং মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ পার্থসারথি সতপথি’র নেতৃত্বে খড়্গপুর আইআইটি’র সঙ্গে জোট বেঁধে গবেষণা শুরু করা হবে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ ভুবন চন্দ্র হাঁসদা জানিয়েছেন, “পরিস্থিতির দিকে সতর্ক নজর রাখা হয়েছে। মেদিনীপুর মেডিক্যাল, খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতাল ও ঘাটাল মহকুমা হাসপাতাল মিলিয়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন শিশু জ্বর নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। তবে, প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক ভাবে রোগ নির্ধারণ বা ডায়াগনসিস করা যাচ্ছে। জেলায় শিশু মৃত্যুর হার অত্যন্ত কম।” পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে জানিয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম স্বাস্থ্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (CMOH) ডাঃ সৌম্যশঙ্কর সারেঙ্গীও।