দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, মণিরাজ ঘোষ ও নবীন কুমার ঘোষ, ২ জুলাই: করোনার প্রথম ঢেউ থেকেই যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল। অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই। পরীক্ষিত ঢাল, তলোয়ার কিছুই ছিলোনা! সীমিত অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া! করোনা আক্রান্তদের জন্য সরকারিভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো প্রথম দিন থেকেই। তা সত্ত্বেও প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে উপসর্গযুক্ত রোগীর ভিড়। কেউবা চাইছেন বাড়িতেই চিকিৎসা করাতে, কারুর বা রিপোর্ট নেগেটিভ হলেও গুরুতর শ্বাসকষ্টের উপসর্গ! বেসরকারি হাসপাতালে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সিটি স্ক্যান করে দেখা যাচ্ছে, কোভিড নিউমোনিয়া! এর সঙ্গে, নিজের কর্মস্থল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজেও সময় দেওয়া। আর, এসব করতে করতেই নিজেও একসময় করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়লেন! তিনি, চিকিৎসক প্রবোধ পঞ্চ্যধ্যয়ী। এই মুহূর্তে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তথা মেদিনীপুর শহরের অন্যতম সেরা ও সুপরিচিত ফুসফুস বিশেষজ্ঞ (Chest Medicine/Pulmonary Medicine)। ২০২০’র ৫ ই সেপ্টেম্বর নাগাদ করোনা সংক্রমিত হয়ে বেশ সংকটজনক অবস্থায় প্রায় ১৫ দিন কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সুস্থ হয়ে ফিরে আসার একমাসের মধ্যেই ফের শুরু করে দিয়েছিলেন, মারণ ভাইরাসের হাত থেকে মানুষ বাঁচানোর লড়াই।
এরপর, ২০২১ এর ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ প্রবেশ করেছে ভারতবর্ষে। পশ্চিম মেদিনীপুর তথা মেদিনীপুর শহরে তা আছড়ে পড়তে পড়তে এপ্রিল! হ্যাঁ, গত কয়েক শতাব্দীতেও জঙ্গলমহলের এই এলাকা তথা সমগ্র অবিভক্ত মেদিনীপুর এমন ভয়াবহ (সঙ্কটজনক) এপ্রিল-মে মাস দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে! জেলায় পর্যাপ্ত অক্সিজেন থাকলেও, জরুরি প্রয়োজনের সময় অক্সিজেনের সঙ্কট; হাজার হাজার টাকা দিয়ে হলেও অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার জন্য মানুষের হাহাকার; শ্বাসকষ্টের রোগীদের নিয়ে প্রিয়জনদের আর্তনাদ; একটা সময় (বিশেষত, মে মাসের প্রথম ২-৩ সপ্তাহ) সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের শয্যা সঙ্কট; সর্বোপরি সুস্থ-সবল কাছের মানুষকে একের পর এক হারানোর বেদনা! এসবের মধ্যেও যে কয়েকজন ‘করোনা যোদ্ধা’ তথা স্বাস্থ্য যোদ্ধা প্রাণ বিপন্ন করে পরিষেবা দিয়ে গেছেন দিন-রাত্রি এক করে তাঁদের মধ্যে অন্যতম মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ডাঃ প্রবোধ পঞ্চ্যধ্যয়ী। রোগী বাঁচানোর তাগিদে, সরকারি ক্ষেত্রের বাইরে গিয়েও বেসরকারি ভাবে চিকিৎসা পরিষেবা দিতে হয়েছে তাঁকে বা তাঁর মতো অনেক চিকিৎসককেই। শহর ও জেলার একটা বড় অংশের সচেতন নাগরিকদের মতে, “হয়তো এজন্যই আরও হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়েছে! শুধু সরকারি হাসপাতালের উপর চাপ পড়লে যে কি হতে পারে, তার নমুনা ২০২১ এর মে মাস জুড়ে দেখা গেছে।” বেসরকারি পরিসংখ্যান বলছে, শুধু মে মাস জুড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০-৩০ জন জেলাবাসী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, হয় কোভিড কিংবা কোভিড সংক্রান্ত উপসর্গ বা কোভিড থেকে সেরে ওঠার পরও! কেউবা বাড়িতে, কেউ সরকারি হাসপাতালে, আবার কেউবা বেসরকারি হাসপাতালে। এই ভয়াবহতার মধ্যেও সকাল থেকে রাত্রি সঙ্কটাপন্ন রোগীদের সেবার নিয়োজিত থেকেছেন শহরের যেসমস্ত ‘করোনা যোদ্ধা’ চিকিৎসক, ডাঃ প্রবোধ পঞ্চ্যধ্যয়ী’র তাঁদের মধ্যে অন্যতম। শুধু প্রত্যক্ষ ভাবে রোগী দেখাই নয়, ফোনে, ভিডিও কলের মাধ্যমে বা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে হাজার হাজার রোগীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বেঙ্গল পোস্টের পক্ষ থেকেও একাধিক রোগীর জন্য যখনই সাহায্য প্রার্থনা করা হয়েছে, তিনি সর্বাগ্রে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি সুস্থ হয়ে ওঠা বেঙ্গল পোস্টের সাংবাদিক কৃষ্ণেন্দু ঘোষ হোক কিংবা সবং কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ তপন দত্ত’ই হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি কখনও ফোন ধরতে কুন্ঠাবোধ করেননি!
এসব প্রশংসা অবশ্য তিনি অবলীলায় অবহেলা করেন, বরং সকলকে পাশে থাকার আবেদন জানিয়ে বলেন, “আমরা আমাদের মতো প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছি। এই অজানা রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কখনোই একশো শতাংশ সফল হওয়া সম্ভব নয়! আমরাও হতে পারিনি। তা সত্ত্বেও অন্তত ৯৮-৯৯ শতাংশ সফল হয়েছি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও সরকারি গাইডলাইনকে মান্যতা দিয়ে। এজন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা বা পরিকাঠামোর সঙ্গে জড়িত একটা বিশাল অংশের মানুষের ধন্যবাদ প্রাপ্য।” তৃতীয় ঢেউ বা ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্টের নতুন উপসর্গ নিয়ে বললেন, “রোগীদের চাপ অনেক কমে গেছে। তৃতীয় ঢেউয়ের ব্যাপকতা কিরকম হবে বলা সম্ভব নয়। তবে, বেশিরভাগ মানুষ ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে, ভয়াবহতা নিঃসন্দেহে কমবে বলেই মনে হয়। যদিও শিশু ও কিশোরদের ক্ষেত্রে একটা আশঙ্কা করা হচ্ছে! এ বিষয়ে যদিও স্বাস্থ্য দপ্তর, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তথা চিকিৎসকরা তৎপর আছেন। আর, এই মুহূর্তে যেসমস্ত রোগী দেখছি, তাঁদের উপসর্গের বিষয়ে বলতে পারি, এখন আর শুধু জ্বর বা শ্বাসকষ্ট নয়, শরীরের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। পেটের সমস্যা, পেটের নীচের অংশে ব্যাথা বা যন্ত্রণা থেকে কিডনি ও মূত্রাশয়ের সমস্যার বিষয়গুলি দেখা যাচ্ছে।” সতর্ক করে দিলেন, “তৃতীয় ঢেউ রুখতেই হবে। একবার যদি ঢুকে পড়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে!”
***প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, করোনার প্রথম পর্বে সেপ্টেম্বর মাসের (২০২০) ৯ তারিখে প্রয়াত হয়েছিলেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ এস এন বেরা (সুরেন্দ্র নাথ বেরা)। মাত্র ৩৬ বছরের এই চিকিৎসকের মৃত্যু শোকস্তব্ধ করে দিয়েছিলো মেডিক্যাল কলেজ তথা শহরের সমগ্র চিকিৎসক মহলকে! সেই শোক কাটিয়ে উঠেও করোনা যুদ্ধে নিরলসভাবে ভাবে সাধারণ মানুষকে যাঁরা পরিষেবা দিয়ে চলেছেন, “মর্ত্যের ঈশ্বর” স্বরূপ, সেই সকল চিকিৎসকদের প্রতিই “বেঙ্গল পোস্ট” (thebengalpost.net) শ্রদ্ধা ও সম্মান নিবেদন করছে! ডাঃ প্রবোধ পঞ্চ্যধ্যয়ী ছাড়াও মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ, শালবনী করোনা হাসপাতাল,খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতাল, ঘাটাল সুপার স্পেশালিটি, ডেবরা সুপার স্পেশালিটি সহ প্রতিটি হাসপাতালের সকল চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াও বেসরকারি ভাবেও প্রতিনিয়ত রোগী দেখে চলা প্রত্যেক চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্য যোদ্ধাদের প্রণাম “চিকিৎসক দিবস” এর এই শুভ মুহূর্ত উপলক্ষে।