দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, রাকেশ সিংহ দেব, ১৯ জানুয়ারি: বলির রক্তের বদলে মাটির মালসায় নৈবেদ্য গ্রহণে আজও তৃপ্ত হন জঙ্গলমহলের জাগ্রতা লৌকিক দেবী শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীমাতা বামুনবুড়ি। আজও তাই পুজো দিতে আসা সমস্ত ভক্তরা চিড়ে ভোগের মাটির মালসা সজিয়ে মায়ের কাছে নিজের মনস্কামনা পূরণের আশায় মানত করেন। কেউ হাজার, কেউবা আরও বেশি মালসা ভোগ মানত রাখেন৷ ফলে সন্ন্যাসী থানে লাখো লাখো মালসা ভোগের লম্বা লাইন পড়ে যায়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনী ব্লকের পিড়াকাটা সংলগ্ন কলসীভাঙ্গার পাড়ুআয়মাতে প্রতি বছর ৩ রা মাঘ বামুনবুড়ি সন্ন্যাসী মাতার আরাধনা করা হয় পূর্ণ ভক্তি নিষ্ঠা সহকারে। এবারও তাই হল। বুধবার (৩রা মাঘ/ ১৮ জানুয়ারি) লক্ষাধিক মালসায় সেজে উঠেছিল বামুনবুড়ি সন্যাসীমাতার মন্দির প্রাঙ্গণ। পুজো উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো (মাঝখানে অতিমারীর কারণে ২ বছর বাদে) এবারও মন্দির সংলগ্ন মাঠে বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে লাখো লাখো ভক্তের উপস্থিতিতে মন্দির চত্বর হয়ে উঠেছে মহামিলন ক্ষেত্র।

thebengalpost.net
লক্ষ লক্ষ মালসায় সেজে উঠেছে মন্দির প্রাঙ্গণ :

পাড়ুআয়মা, পাথরি, বুড়িপালা, কলসীভাঙ্গা সহ আশেপাশে ২০-২৫টি গ্রামের জাগ্রতা দেবী হলেন বামুনবুড়ি সন্ন্যাসী মাতা। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে এই দেবীর পুজোর প্রচলন শুরু করেছিলেন কলসীভাঙ্গা গ্রামের জনৈক লক্ষীকান্ত মাহাত। তিনি গত হওয়ার পর তাঁর বংশধরেরা এখনো এই পুজো করে আসছেন পুরনো রীতিনীতি মেনেই। জঙ্গলাকীর্ণ এই এলাকায় অতীতের ন্যায় আজও জঙ্গল থেকে কাঠপাতা এনে এবং গোচারন করে সংসার প্রতিপালন করেন এলাকার মানুষজন। কথিত আছে একবার লক্ষীকান্ত মাহাত’র এক আত্মীয় গোরু চরাতে গিয়েছিলেন জঙ্গলে। সারাদিন ধরেই জঙ্গলে গোরু চরে বেড়িয়েছিল। বিকেলে গোরু নিয়ে ঘর যাওয়ার সময় তিনি দেখেন একটি বলদ নেই। অনেক খুঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাওয়া যায়না। তিনি এই কথাটি জানান আত্মীয় লক্ষীকান্ত মাহাত’কে। তিনিও খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে একটি বেল গাছের নীচে বসে ভাবতে থাকেন কি করবেন, কোথায় যাবেন। বেশিকিছু ভাবতে না পেরে ‘বনদেবী’র নাম স্মরণ করেন! এমন সময় এক বৃদ্ধা তাঁর সামনে আসেন এবং বলেন যে, গোরুটি জঙ্গলের কোনখানে আছে এবং গোরুটি নিয়ে আসতেও বলেন। লক্ষীকান্ত বাবু তৎক্ষনাৎ ছুটে গিয়ে দেখেন বয়স্কার কথা মতো গোরুটি সেই স্থানেই দাঁড়িয়ে আছে! তিনি গোরু নিয়ে আবার সেই বেল গাছের তলায় ফিরে এসে দেখেন, বৃদ্ধা তখনও বসে আছেন সেই গাছেরই নীচে। লক্ষীকান্ত বাবু তখন তাঁর কাছে করজোড়ে জানতে চান, তাঁর আসল পরিচয়। তখন বৃদ্ধা জানান যে, তিনি সন্ন্যাসী মাতা বামুন বুড়ি। এই জঙ্গলেই তাঁর বাস। এখানে তাঁর পুজোর কথা বলেন। তিনি জানিয়ে যান যে, এই জঙ্গলে যদি কারো কোনো সমস্যা হয় বা কেউ বিপদে পড়ে, তবে তাঁকে যেন স্মরণ করে, তিনি উদ্ধার করবেন।

তারপর থেকেই ওই স্থানে বামুন বুড়ি সন্ন্যাসী মাতার পুজো শুরু হয়। শোনা যায় এলাকার অনেকেরই গবাদিপশু জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার পর, এই দেবীর স্মরনাপন্ন হওয়ার পর গবাদিপশু ফিরে পেয়েছেন সকলেই। লক্ষীকান্ত বাবু মারা যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ মাহাত এই পুজো এবং মেলার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটান। বর্তমানে কংক্রিটের সাদা ধবধবে মন্দির তৈরি করা হয়েছে। গর্ভগৃহে হাতি ঘোড়ার ছলনে পূজিতা হন দেবী। বিশাল মেলা বসে। রবীন্দ্রনাথ বাবু’র দাদা ত্রিলোচন মাহাত মেলার অন্যতম কর্মকর্তা। বর্তমানে মায়ের সেবাইত আছেন কালিপদ মাহাত। প্রতিবছর ৩ রা মাঘ খুব ধমধাম সহকারে পুজো করা হয়। এছাড়াও, নিত্য পুজো হয় প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবার। এবারও, বার্ষিক পুজোতে প্রায় ২-৩ লক্ষ মালসা মানত পড়েছিল বলে খবর। পুজোর সময় সমস্ত মালসাগুলি চিঁড়ে কলা আর বাতাসা দিয়ে মন্দিরের সামনে সাজিয়ে রাখা হয়। সারা মন্দিরের সিঁড়ি থেকে মন্দির চত্বর ভরে ওঠে মালসায়। স্থানাভাবে অবশ্য সব মালসা সাজানো সম্ভব হয়ে ওঠেনা! বামুনবুড়ি মেলা কমিটির সদস্যরা জানান, দুইদিন ধরে চলা এই পুজোতে মেলারও আয়োজন করা হয়। মেলাতে লাখ লাখ দর্শক হাজির হয়। মেলা উপলক্ষে কবিগান, বাউল গান, পালা কীর্তন, যাত্রাপালা সহ সারা রাত্রিব্যাপী নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি রক্তদান শিবিরেরও আয়োজন করা হয়। জেলা শহর মেদিনীপুর থেকে মাত্র ২০-২৫ কিলোমিটারের দূরত্বে অবস্থিত কলসীভাঙার জঙ্গলের মাঝে এই দেবীর পুজো ও মেলা ঘিরে আপামর জেলাবাসীর এক অন্যরকম আবেগ কাজ করে।

thebengalpost.net
সাজানো হয়েছে মানতের মালসা :

thebengalpost.net
মেলায় হাজার হাজার মানুষের ভিড় :