মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১০ অক্টোবর: “ওরা কাজ করে।” ওঁরাই মণ্ডপ তৈরী করেন। গড়ে তোলেন প্রতিমা। আরও যা কিছু ‘সুন্দর’, তা ওঁদের হাত দিয়েই মূর্ত হয়ে ওঠে। শিল্পী প্রশান্ত খাটুয়ার ভাবনায় ও সৃজনে জেলা শহর মেদিনীপুরের রবীন্দ্রনগর সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি এবারের পুজোয় তাঁদের মণ্ডপ ‘উৎসর্গ’ করেছেন এই শিল্পীদেরই। মণ্ডপের ভেতরের অনবদ্য ও অভিনব কারুকার্যে এবং ভিজুয়াল মাধ্যমে মন্ডপশিল্পী, মৃৎশিল্পীদের অসাধারণ সব কর্মকান্ড ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মন্ডপের বাইরের অংশে বাংলা তথা ভারতের আদি অনন্ত লোকসংস্কৃতির রূপ প্রস্ফুটিত। আর অনন্য এই মণ্ডপসজ্জার কোথাও থার্মোকলের মতো নিষিদ্ধ জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়নি। টিন, বাঁশ, কাপড়, কাঁচ, কার্ড বোর্ড প্রভৃতি পরিচিত বা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়েই রবীন্দ্রনগরের ৫৫-তম বর্ষের এই ‘উৎসর্গ’ নামাঙ্কিত মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে। এবারের, বিশ্ববাংলা শারদ সম্মানেও তাই ‘সেরা পুজো’-র খেতাব জিতে নিয়েছে মেদিনীপুর শহরের রবীন্দ্রনগর সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি। রবীন্দ্রনগর ছাড়াও, সেরা পুজোর সম্মান জিতে নিয়েছে আরও তিনটি পুজো কমিটি। এগুলি হল- গড়বেতার ধাদিকা সর্বজনীন দুর্গোৎসব (যুব গোষ্ঠী) কমিটি, ঘাটালের সোনাখালী স্কুলপাড়া সর্বজনীন দুর্গোৎসব সংঘ এবং সবংয়ের তেমাথানি পল্লীশ্রী সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটি।
গড়বেতার ধাদিকা সর্বজনীন দুর্গোৎসব (যুব গোষ্ঠী) কমিটির থিম বা মণ্ডপ হল- ‘চারধাম’। বদ্রীনাথ, দ্বারকা, পুরী ও রামেশ্বরম- এই ‘চারধাম’ বা প্রসিদ্ধ হিন্দু ধর্মস্থান ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সবংয়ের তেমাথানি পল্লীশ্রী সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটির এবারের থিম হল- “কারু শিল্পে বাংলা বাঁচে, দেবীর বোধন নব সাজে।” ৩৮তম বর্ষের পুজোয় শিল্পী সমীরণ খুটিয়া নিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলার কারু শিল্পকলা। পুজো কমিটির সভাপতি শেখ আবু কালাম বক্স এবং সম্পাদক রাজীব দত্ত জানান, “পঞ্চমী থেকেই ভিড় উপচে পড়ছে। ষষ্ঠীতে তো জন প্লাবন!” বন্যা বিপর্যয় কাটিয়ে ঘাটালের সোনাখালী স্কুলপাড়াও চোখধাঁধানো মণ্ডপ আর প্রতিমা গড়ে জিতে নিয়েছে এবারের সেরা পুজোর খেতাব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বুধবার অর্থাৎ ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় মেদিনীপুর শহরে অবস্থিত জেলাশাসকের কার্যালয়ে আয়োজিত ‘বিশ্ববাংলা শারদ সম্মান’-র ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসন তথা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের তরফে মোট চারটি বিভাগে জেলার ১৩টি পুজো কমিটিকে ‘সেরা’ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। সেরা পুজো, সেরা মণ্ডপ, সেরা প্রতিমা এবং সেরা সমাজসচেতনতা- এই চারটি বিভাগে মোট ১৩টি পুজো কমিটিকে পুরস্কৃত করা হয় এদিন। সেরা প্রতিমা বিভাগে যে ৩টি পুজো কমিটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম পিড়াকাটা বাজার দুর্গোৎসব কমিটি। শিফন সুতো দিয়ে তৈরি হয়েছে পিড়াকাটা বাজারের এবারের প্রতিমা। প্রতিমার সাবেকি ও চিরন্তনী মাতৃরূপে মুগ্ধ হচ্ছেন আট থেকে আশি সকলেই। প্রসঙ্গে এও উল্লেখ্য যে, শালবনী ব্লকের পিড়াকাটা বাজারের মণ্ডপ হয়েছে রাজস্থানের জয়পুরের অ্যালবার্ট হল মিউজিয়ামের আদলে। জঙ্গলমহলের পিড়াকাটা বাজার দুর্গোৎসব কমিটির ৭ম বর্ষের পুজোয় এবার মোট বাজেট প্রায় ২২-২৩ লক্ষ টাকা বলে জানিয়েছেন কমিটির তরফে পরিমল ধল, গৌতম দাস, প্রবীর সাউ, শমিত দাসরা। মেদিনীপুর শহরের বিবিগঞ্জ সর্বজনীন দুর্গোৎসবের প্রতিমা এবারও ছিনিয়ে নিয়েছে ‘সেরা প্রতিমা’র খেতাব। এছাড়াও, ঘাটালের কৈগেঁড়া সর্বজনীন দুর্গোৎসবের প্রতিমাও এই বিভাগে পুরস্কৃত হয়েছে।
অপরদিকে, কোরালার জগৎ বিখ্যাত নৃত্যশৈলী ‘কথাকলি’ সহ নানা শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ডপ সজ্জায় ফুটিয়ে তুলে সেরা মণ্ডপের স্বীকৃতি জিতে নিয়েছে খড়্গপুর শহরের প্রেমবাজার সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটি। মেদিনীপুর শহরের রাঙামাটি সর্বজনীন দুর্গোৎসবের ৫৬তম বর্ষের থিম ‘আলোক স্পর্শে দশভুজা’। মণ্ডপসজ্জায় ব্যবহৃত হয়েছে আয়রন ঝুড়ি, ফাইবারের কাপ, প্লেট, চামচ প্রভৃতি। রাঙামাটির আলোকসজ্জা এবার জেলার অন্যতম সেরা। তাই, মণ্ডপে সেরার খেতাব জিতেছে মেদিনীপুর শহরের রাঙামাটিও। এছাড়াও, ঘাটালের সানরাইজ ক্লাব ও গ্রামবাসীবৃন্দের মণ্ডপও পেয়েছে সেরা মণ্ডপের শিরোপা। সমাজসচেতনতায় সেরা- মেদিনীপুর শহরের শরৎপল্লীর সৃজনী, ঘাটালের মানিককুন্ডু এবং খড়গপুর শহরের হিজলি দুর্গা মন্দির। এছাড়াও, মেদিনীপুর-খড়্গপুরের যে মণ্ডপগুলি এবার দর্শকদের বিচারে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে, সেগুলি হল- খড়্গপুর শহরের তালবাগিচার দু’টি মণ্ডপ, মেদিনীপুর শহরের ছোটবাজার (মালয়েশিয়ার টুইন টাওয়ার), কোতবাজার (চিচিং ফাঁক), রাজাবাজার (বাওয়ালি রাজবাড়ি), বার্জটাউন (বন্দী), অরবিন্দনগর, পাটনাবাজার প্রভৃতি।