দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৩ জুলাই: পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গল অধ্যুষিত শালবনীতে কুড়মি জনজাতির ভোট বরাবরই একটা বড় ফ্যাক্টর। আর এবার ‘নিজেদের ভোট নিজেদের ঘরে’ রাখার স্লোগান দিয়ে, কুড়মিরা স্বয়ং ভোট-যুদ্ধে সামিল হয়েছেন। শালবনী ব্লকের বেশ কয়েকটি কুড়মি অধ্যুষিত আসনে শাসকদলকে রীতিমতো কড়া চ্যালেঞ্জের মুখেও ফেলে দিয়েছেন তাঁরা। শালবনী ব্লকের ৪ নম্বর বাঁকিবাঁধ অঞ্চলের ১৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে ৮টি আসনে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে কুড়মি সমাজের তরফে। ২টি পঞ্চায়েত সমিতির আসনেও তাঁরা প্রার্থী দিয়েছেন। ৮টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে ৭ টিতেই কুড়মিরাই এগিয়ে আছেন বলে দাবি করা হয়েছে তাঁদের নেতৃত্বের তরফে। এমনকি, শাসকদলের তরফেও একপ্রকার স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে ৭টি না হলেও, এই অঞ্চলের (বাঁকিবাঁধ) ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে তাঁরা কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে চলেছেন। এই সমস্ত বুথ বা সংসদে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ কুড়মি সমাজের হওয়ায় চাপে শাসকদল!

thebengalpost.net
তৃণমূল ও কুড়মিদের পতাকায় ছেয়েছে এলাকা :

এমনকি, বাঁকিবাঁধ অঞ্চলের ঢ্যাঙাশোল বুথে বা গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে আবার শাসকদলের সঙ্গে সরাসরি লড়াই কুড়মিদের। শাসকদলকে চাপে ফেলতে এই আসনে বাম-বিজেপি’ও প্রার্থী দেয়নি বলে অভিযোগ তৃণমূল কংগ্রেসের বুথ সভাপতি শ্রীদাম ঘোষের। তাঁর অভিযোগ, “এখানে বাম-বিজেপির সঙ্গে কুড়মিদের গোপন আঁতাত হয়েছে! ‘দ্বিমুখী’ লড়াইয়ের জন্যই আমরা একটু চাপে আছি, এটা ঠিক। কারণ, কুড়মি প্রভাবিত এই বুথে কুড়মিদের ভোট ভাগাভাগি হওয়ার সুযোগ কম। তবে, ওরা জতিসত্ত্বার জন্য লড়ছে, আর আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সার্বিক উন্নয়নের বার্তা নিয়ে মানুষের কাছে যাচ্ছি। গতবার এখানে আমরা জিতেছিলাম। এলাকায় প্রায় সমস্ত কাজই হয়েছে, যাতে আরও উন্নয়ন করা যায়; লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্পের সুবিধা থেকে কেউ যাতে বঞ্চিত না হয়; সেই বার্তা নিয়েই যাচ্ছি। কঠিন লড়াইয়ের মুখে পড়তে হলেও, শেষ পর্যন্ত এই বুথেও আমরাই জিতবো।” ধান্যশোল, বাঁকিবাঁধ, ঝড়ভাঙা, জুয়ালভাঙা, শালডহরা সহ এই অঞ্চলের অন্যান্য আসনগুলিতে বাম-বিজেপির প্রার্থী থাকলেও, সেখানেও এবার কুড়মিদের পাল্লা ভারি বলে দাবি করা হচ্ছে। গত (২০১৮) পঞ্চায়েত নির্বাচনেও অবশ্য বাঁকিবাঁধ, ঝড়ভাঙা, জুয়ালভাঙা এবং শালডহরা আসন জিততে পারেনি তৃণমূল। জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল বিরোধীরা (বিজেপি ও বামেরা)। এবার আবার বাম-বিজেপি ও কুড়মিদের তলে তলে সমঝোতা হয়েছে বলে তৃণমূলের অভিযোগ। তৃণমূলের কিছু বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরাও টিকিট না পেয়ে কুড়মিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ!

বাঁকিবাঁধ গ্রাম পঞ্চায়েতের বিদায়ী প্রধান তথা ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের এস.সি সেলের সভাপতি ও অঞ্চল তৃণমূলের সহ-সভাপতি কৌশিক দোলই বলেন, “গতবার ১৪টি আসনের ১০টিতে জিতে আমরা বোর্ড গঠন করেছিলাম। মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় এবং শালবনী সমিতির সহায়তায় এলাকার সার্বিক উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছিলাম। পানীয় জল, রাস্তাঘাট সহ কোন কিছু নিয়েই এলাকাবাসীর অভিযোগ নেই। তার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামাজিক প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন প্রত্যেকেই। তাঁরা জানেন দিদি ছাড়া, তৃণমূল ছাড়া কোনও বিকল্প নেই।” তবে তিনিও মানছেন, “এবার গ্রাম পঞ্চায়েত আসন বেড়ে হয়েছে ১৯টি। কুড়মি প্রভাবিত ৬টি ছাড়া ১৩টিতেই আমরা বিপুল ভোটে জিতব। এই ৬টিতেও বহু কুড়মি মানুষ আমাদেরকেই ভোট দেবেন। আর, কুড়মি সম্প্রদায় ছাড়া বাকি ১০০ শতাংশ ভোটই আমরা পাবো।” যদিও তাঁর আশঙ্কা, “কুড়মিদের বেশিরভাগ অংশই এখানে শাসকদলের সঙ্গেই ছিল। বাম-বিজেপির সমর্থন এবং আমাদের দলের কিছু বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীর উস্কানিতে একটু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তবে, আমরাও এই বিক্ষুব্ধদের চিহ্নিত করছি। আগামীদিনে তাদের পুরোপুরি বহিষ্কার করবে দল। শেষ পর্যন্ত বোর্ড আমরাই গঠন করব। তখন সেই তৃণমূলের ছত্রছায়াতেই আসতে হবে সবাইকে। তাই, শেষ পর্যন্ত ঢ্যাঙাশোল সহ ওই ৬টি আসনেও হয়তো মানুষ মুখমন্ত্রীর পক্ষেই ভোট দেবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।” অন্যদিকে, কুড়মিদের ঘাঘর ঘেরা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা এই অঞ্চলের কুড়মি নেতা সুমন মাহাত’র দাবি, “৮টির মধ্যে ৭টিতে আমরা নিশ্চিতভাবে জিতবো। ৮টাও জিততে পারি। কারণ, এই আসনগুলির বেশিরভাগ ভোটার আমাদের সম্প্রদায়ের। তাঁরা নিজেরাই ভোটে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, প্রার্থী নির্বাচন করেছেন এবং প্রচার করছেন। তাঁরা জানেন, ৭৩ বছর ধরে আমরা বঞ্চিত। কোনও রাজনৈতিক দল আমাদের দাবি পূরণের কথা ভাবেনি। আর, বর্তমান শাসকদলের সাধারণ সম্পাদক তো বলেই দিয়েছেন আমাদের ভোটের ওদের দরকার নেই! আর, বিরোধী দলের এক নেতা বলেছেন আমাদের লুঙ্গি খুলে নেবে! তাই, আমরা নিজেরাই ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধ্য হয়েছি। আর, সেই লড়াইয়ে আমাদের সমাজের মানুষ আমাদের পাশেই থাকবেন।” এই বিষয়ে শালবনী পঞ্চায়েত সমিতির বিদায়ী কর্মাধ্যক্ষ তথা মেদিনীপুর সাংগঠনিক জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতি সন্দীপ সিংহ বলেন, “কুড়মিদের একটা বড় অংশ আমাদের সঙ্গেই আছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই আছেন। ওই অঞ্চলে ৪টি আসনে আগেও বিরোধীরা জিতেছেন। ৬টিতে কুড়মিদের প্রভাব আছে। কিন্তু, ওই অঞ্চলে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি সহ আমাদের বেশিরভাগ প্রার্থীও কুড়মি সম্প্রদায়ের। আর, শালবনী ব্লকের জেলা পরিষদের ৩টি আসনের মধ্যে ২টিতে কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষকেই প্রার্থী করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তাঁরাও বলছেন, রাজনৈতিক আন্দোলন আলাদা, সামাজিক আন্দোলন আলাদা। সামাজিক দাবি বা লড়াইয়ে তাঁদের পাশে সকলেই আছেন। কিন্তু, রাজনৈতিক আন্দোলন বা রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া যে কোনও বিকল্প নেই; তা মানছেন কুড়মি সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ।”