দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৯ ফেব্রুয়ারি: বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিলেন মেদিনীপুর আদালতের ষষ্ঠ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক সেলিম শাহী। আজ, বৃহস্পতিবার বাকি ১০ জনের ক্ষেত্রেও একই ‘রায়’ শোনালেন বা সাজা ঘোষণা করেন বিচারক। সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে যাবজ্জীবন বা আমৃত্যু কারাদণ্ড (Life Imprisonment) এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা (অনাদায়ে আরও ৩ মাসের জেল)-র নির্দেশ দিয়েছেন মেদিনীপুর আদালতের বিচারক সেলিম শাহী। খুন, রাষ্ট্রদ্রোহ সহ প্রায় ১৪টি ধারায় সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি আইনজীবী তথা সিআইডি-র আইনজীবী দেবাশীষ মাইতি বলেন, “একাধিক ধারায় সাজা ঘোষণা করেছেন বিচারক। সবগুলোই একসঙ্গে চলবে। সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। তবে, ফাইনটা একসঙ্গে মিলিয়ে (প্রায় ২০-২৫ হাজার টাকা) যেটা হবে; দিতে হবে।” বুধবারের পর বৃহস্পতিবারও আদালত চত্বরে বিক্ষোভ দেখিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর (APDR)। সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ এনে উচ্চ আদালতে (কলকাতা হাইকোর্টে) যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, বুধবার সাজাপ্রাপ্ত মনসারাম হেমব্রম ওরফে বিকাশের মতোই, এদিনও সাজাপ্রাপ্তদের তরফে অভিযোগ করা হয়েছে, সাক্ষীদের বাংলাদেশ, পাকিস্তান থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছে! বিচারকও ‘সরকারের লোক’ বলে অভিযোগ এনেছেন তাঁরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার ঠিক মুখে ঝাড়গ্রামের শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে (EFR Camp) ভয়বাহ মাও হামলায় (Maoist Attack) প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৪ জন জওয়ান। দীর্ঘ বিচার-প্রক্রিয়া শেষে মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সেই মামলাতেই ২৩ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে মেদিনীপুর জেলা আদালত (Midnapore Judges Court)। বুধবার ও বৃহস্পতিবার সাজা ঘোষণা করা হয়। প্রত্যেকেরই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। সঙ্গে করা হয়েছে আর্থিক জরিমানাও। বুধবার ও বৃহস্পতিবার মিলিয়ে যে ২৩ জন মাও নেতার (তৎকালীন) যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হল- ১. মনসারাম হেমরম ওরফে বিকাশ ২. ঠাকুরমনি হেমব্রম ওরফে তারা ওরফে পাখি (বিকাশের স্ত্রী) ৩. কল্পনা মাইতি ওরফে অনু ওরফে রীনা ৪. মানস মাহাতো ৫. কাজল মাহাতো ৬. মঙ্গল সরেন ৭. সনাতন সরেন ৮. শুকলাল সরেন ৯. কানাই হাঁসদা ১০. রাজেশ হাঁসদা ওরফে ভাঁটু ১১. শ্যামচরন হাঁসদা ১২. রাজেশ মুণ্ডা ১৩. ইন্দ্রজিৎ কর্মকার। এঁদের বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সাজা ঘোষণা করা হয়েছিল। আর, বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) ১৪. রঞ্জন মুন্ডা ১৫. লোচন সিং সর্দার ১৬. চুনারাম বাস্কে ১৭. আশিষ মাহাতো ১৮. ধৃতিরঞ্জন মাহাতো ১৯. বিষ্ণু সরেন ২০. অর্ণব দাম ২১. রামসাই হাঁসদা ২২. প্রশান্ত পাত্র এবং ২৩. বুদ্ধেশ্বর মাহাতো-র যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, মাও নেতা কিষেণ জী-র নির্দেশে ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঠিক সন্ধ্যার মুখে শিলদা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে থাকা EFR ক্যাম্পে ভয়াবহ হামলা চালায় মাওবাদীরা। জওয়ানরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি করে, ক্যাম্পে আগুন লাগিয়ে ২৪ জন EFR জওয়ানকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে বিকাশ, তারা সহ মাওবাদীদের একটি দল। জওয়ানদের পাল্টা প্রতিরোধে ৫ জন মাওবাদীরও মৃত্যু হয়েছিল। মাও নেতা কিষেণ জী-র নির্দেশি এই হামলা চলে! ভয়াবহ এই হামলার পরই ওই জায়গা থেকে EFR ক্যাম্প তুলে দেওয়া হয়েছিল। সেই EFR ক্যাম্পের অদূরে (শিলদাতেই) করা হয় রাজ্য পুলিশের স্ট্রাকো ক্যাম্প। এই মামলায় প্রথম গ্রেপ্তার হন মাও নেতা রঞ্জন মুন্ডা। তারপর, একের পর এক মাও নেতা-নেত্রী গ্রেপ্তার হন। অধরা ছিলেন মাও নেত্রী সুচিত্রা মাহাত, জাগরী বাস্কে সহ কয়েকজন। পরে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন সুচিত্রা, জাগরী-রা। এখন তাঁরা সুখে ঘর-সংসার করছেন। রাজ্য পুলিশে দেওয়া হয়েছে চাকরি। FIR-এ নাম থাকলেও চার্জশিট থেকে তাদের নাম বাদ যায় বলে অভিযোগ বিকাশ, তারা সহ চার্জশিটে নাম থাকা ২৪ জনের পরিবারের সদস্য থেকে তাঁদের আইনজীবীদের। এঁদের মধ্যে সুদীপ চোংদার (ওরফে কাঞ্চন) নাম এক পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার এক মাওবাদী নেতার মৃত্যু হয় বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন। বাকি ২৩ জনকেই মঙ্গলবার দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বুধবার ও বৃহস্পতিবার তাঁদের সাজা ঘোষণা করেন বিচারক সেলিম শাহী। প্রত্যেকেরই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত ২৩ মাওবাদী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা সহ মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর (APDR) এর অভিযোগ, “বিচারক একসময় রাজ্য ওয়াকফ ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন, তাই ন্যায্য বিচার হয়নি। সরকার যা চেয়েছে, তাই হয়েছে।” তাঁদের আরও অভিযোগ, “জল-জঙ্গল-জমির আন্দোলন করা আদিবাসীদের এমন শাস্তিই দেওয়া হয়!” একইসঙ্গে, সুচিত্রা মাহাত, জাগরী বাস্কে-দের নাম চার্জশিট থেকে কেন বাদ গেছে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা। সরকারি আইনজীবী দেবাশীষ মাইতির দাবি, প্রশ্ন যে কেউ তুলতেই পারে, তবে তাঁর এমন কিছু জানা নেই!