দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৪ মার্চ: ২০২১ সালে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ (Azadi Ka Amrit Mahotsav) বা স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনের সূচনা লগ্নে দেশের যুবক-যুবতীদের জন্য এক অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর (PMO)। মেন্টরিং যুবা (Mentoring Yuva) বা পি.এম যুবা মেন্টরশিপ প্রকল্পে দেশের তরুণ প্রজন্ম তথা যুবক-যুবতীদের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের অচেনা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্বন্ধে বা স্বাধীনতা সংগ্রামের অজানা ইতিহাস সম্পর্কে লেখার আহ্বান জানানো হয়। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে সেই যুবক-যুবতীদের মধ্যে ৭৫ জনের লেখা বা ইতিহাস বেছে নেওয়া হবে বলেও জানানো হয় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে। এই প্রকল্পে দেশের সেই ৭৫ জন যুবক-যুবতীকে ৬ মাসের জন্য মোট ৩ লক্ষ টাকা (প্রতি মাসে ৫০ হাজার) স্কলারশিপ বা বৃত্তি (scholarship) প্রদানের সাথে সাথে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের পক্ষ থেকে সেই বই প্রকাশের ঘোষণাও করা হয়। সম্প্রতি, বেছে নেওয়া হয়েছে দেশের ৭৫ জন ‘উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক’-কে। ‘দিল্লি বই মেলা’-তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের বইও। তাঁদের প্রত্যেকেরই বয়স ৩০ এর মধ্যে। কেউ কেউ আবার সদ্য ১৮ পেরিয়েছেন। সেই তালিকাতেই আছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা বছর ১৯ এর সৌহার্দ্য দে।

thebengalpost.net
নিজের বই হাতে সৌহার্দ্য:

মেদিনীপুর শহরের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতনের পড়ুয়া হিসেবে কলা বিভাগ (Humanities) থেকে সর্বোচ্চ (প্রায় ৯৭.২৫ শতাংশ) নম্বর পেয়ে সদ্য (২০২২) উচ্চ মাধ্যমিক (ISC) পাস করে এই মুহূর্তে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ বছরের জন্য পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন সৌহার্দ্য। উল্লেখ্য যে, একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় অর্থাৎ মাত্র ১৭ বছর বয়সেই প্রাচীন ইতিহাস বা পুরানের একনিষ্ঠ এক গবেষক ও লেখক হিসেবে সৌহার্দ্য ‘প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় বাল পুরস্কার-২০২১’ এ পুরস্কৃত হয়েছিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই রামায়ণ অনুসরণে রামচন্দ্রের বীরগাথা (Scion of Suryavansham/ সূর্য বংশের কুলতিলক) রচনা তাঁর অন্যতম কীর্তি। এছাড়াও, মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পুরাণ ও ইতিহাস অবলম্বনে রচিত তাঁর একাধিক গল্প, উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। আবারও, নজির সৃষ্টি করলেন মেদিনীপুরের এই ‘বিস্ময় প্রতিভা’। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন অযোধ্যার অধীনস্থ কালকানকরের বিশেন রাজপুত বংশীয় তালুকদার রাজকুমার লালপ্রতাপ সিং এর বীরচরিত্র অবলম্বনে সৌহার্দ্য লিখেছেন ‘প্রতাপজং: দ্য আলটিমেট স্যাক্রিফাইস’ বইটি। সৌহার্দ্য বলেন, রাজকুমার লালপ্রতাপ সিং এর অযোধ্যার দরবারী রাজনীতিতে কূটনৈতিক দক্ষতা ও বীরত্বের সঙ্গে ইংরেজ বিরোধী যুদ্ধ পরিচালনার অনালোচিত বীরগাথা তাঁর এই ঐতিহাসিক উপন্যাসে উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে কলকাতার বেলভিডিয়ার হাউসে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি কিভাবে কূটনৈতিক চাতুর্যের মাধ্যমে হ্যালিডের সঙ্গে পরামর্শক্রমে অযোধ্যা অধিগ্রহনের নির্দেশ প্রস্তুত করেছিলেন, তাও সুচারু রূপে এখানে বিশ্লেষিত হয়েছে। সেই সঙ্গে আলোচিত হয়েছে লালপ্রতাপের রণনিপুনতায় চিনহাটের যুদ্ধে ইংরেজদের পরাজয় এবং বেগম হজরত মহলের সৈন্যদের জয়লাভে লালপ্রতাপের অবদান। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সৌহার্দ্য জানিয়েছেন, “আমার এই বই লেখার ভাবনা আজকের নয়। আমি যখন প্রথম স্ট্যাম্প সংগ্রহ করতে গিয়ে লালপ্রতাপের নামটির সঙ্গে পরিচিত হই। তখন থেকেই আমার মনে কৌতুহল ছিল লালপ্রতাপকে নিয়ে । আমি স্ট্যাম্প সিরিজের অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে লেখা বই পেলেও, লালপ্রতাপকে নিয়ে তেমন কিছু পাইনি। তাই, স্বাধীনতার ৭৫বছরে পিএম যুবা স্কীমের দ্বারা যখন অজানা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে বইয়ের খসড়া চাওয়া হয়, তখন স্বাভবিকভাবেই লালপ্রতাপের কথা প্রথম আমার ভাবনায় আসে।”

thebengalpost.net
বাংলার চার প্রতিভা :

অন্যদিকে, সৌহার্দ্য ছাড়া এই প্রকল্পে বাংলার আরো তিন প্রতিভাময়ীর বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরাও পেয়েছেন ৬ মাসের বৃত্তি স্বরূপ ৩ লক্ষ টাকা। এঁরা হলেন যথাক্রমে- বনগাঁর (উঃ ২৪ পরগনা) মৌলি রায়, বাঁকুড়ার রাংকিনী হাঁসদা এবং কল্যানী (নদীয়া)’র সুস্মিতা হালদার। এর মধ্যে, মৌলি ও সুস্মিতা বাংলা ভাষাতেই স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সৌহার্দ্য ইংরেজি ভাষাতে অযোধ্যার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে, সাঁওতালি ভাষাতে রাংকিনী হুল বিদ্রোহের অজানা ইতিহাস তুলে ধরেছেন। বনগাঁর মৌলির গবেষণার বিষয় ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নিভৃতচারিণী চারুপ্রভা সেনগুপ্তের জীবন। ‘আগুনপাখি চারুপ্রভা’ নামে বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। বাঁকুড়ার মেয়ে রাংকিনী ছোট থেকেই কবিতা লেখেন। সাঁওতালি ভাষায় তাঁর বই ‘হুলগারিয়া রুকনি হাঁসদা’ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বভারতী’র ছাত্রী রাংকিনী বলেন, “হুল বিদ্রোহে যোগ দেওয়া অনেক নারীর কথা শোনা গেলেও রুকনি হাঁসদার নাম সে ভাবে আলোচিত নয়। তিনি হুল বিদ্রোহে পুরুষের বেশে মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করেছিলেন।” ঝাড়গ্রামের ভূমিকন্যা হলেও কর্মসূত্রে নদীয়ার কল্যাণীতে থাকেন সুস্মিতা হালদার। পড়ান হুগলির সরকারি আইন কলেজে। পেশা আইন শিক্ষা হলেও নেশায় রয়েছে ইতিহাস চর্চা। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে সুযোগ পেয়ে সুস্মিতা কাজ করেছেন লায়েক বিদ্রোহ নিয়ে। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা ও আশপাশের অঞ্চলের (তৎকালীন বগড়ি পরগনা) লায়েক বিদ্রোহের কাহিনী নিয়েই সুস্মিতার বই ‘লায়েক-গাথার নায়ক-খোঁজে’। যে অঞ্চল নিয়ে কাজ করেছেন সেখানকার ঐতিহ্যের স্বীকৃতির দাবিতেও কাজ করতে চান সুস্মিতা। বলেন, “আমি লায়েক বিদ্রোহ নিয়ে আরও কাজ করতে চাই। শুরুও করে দিয়েছি। সেই সঙ্গে গড়বেতার এই এলাকা যাতে ‘হেরিটেজ’ মর্যাদা পায় সেই আবেদনও করেছি। চাই বাংলার ইতিহাস আঞ্চলিকতার গণ্ডি পেরিয়ে যেন জাতীয় স্তরের ইতিহাসে জায়গা করে নেয়।”

thebengalpost.net
গড়বেতায় সুস্মিতা হালদার (ফাইল ছবি):

thebengalpost.net
দিল্লির মঞ্চে :