মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২২ সেপ্টেম্বর: সমাজসেবা ও সাহিত্যকর্মে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি বিদ্যাসাগরের মেদিনীপুরে, তাঁরই নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে। পুরস্কারও তাঁর নামেই! ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার ২০২২’ সম্মানে ভূষিত হলেন ‘মেদিনীপুরের গর্ব’ সমাজকর্মী ও প্রাবন্ধিক রোশেনারা খান, কথা সাহিত্যিক অমর মিত্র, নাট্যকার গৌতম মুখোপাধ্যায় এবং ভাষা গবেষক জি.এন. দেভি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম আদর্শ শিল্পী, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক তথা ‘নবজাগরণের অগ্রদূত’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০৩-তম জন্মজয়ন্তী (২৬ সেপ্টেম্বর) উপলক্ষে, বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে “বিদ্যাসাগর পুরস্কার” তুলে দেওয়া হল বঙ্গ সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রদের হাতে। তবে, প্রথম তিনজন সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারলেও, সাহিত্যিক ও ভাষা গবেষক জি.এন. দেভি এদিন অনুপস্থিত ছিলেন।

thebengalpost.net
স্বীকৃতির মঞ্চে:

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকানন্দ সভাগৃহে এক মর্যাদাপূর্ণ অনুষ্ঠান থেকে এদিন পুরস্কার তুলে দেওয়া হল, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘নাট্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার’ প্রাপ্ত নাট্যকার গৌতম মুখোপাধ্যায়, ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার’ প্রাপ্ত কথা সাহিত্যিক অমর মিত্র এবং ‘মেদিনীপুরের গর্ব’ সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী রোশেনারা খান- এর হাতে। তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন ২০২১ সালে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কারে’ সম্মানিত যথাক্রমে- প্রতুল মুখোপাধ্যায়, নলিনী বেরা এবং অন্নপূর্ণা চট্টোপাধ্যায়। এছাড়াও, এদিন “অধ্যাপক সুধীর রঞ্জন দাস স্মৃতি পুরস্কার” তুলে দেওয়া হল, বাংলা ও ভারতের স্বনামধন্য পুরাতত্ত্ববিদ ড. শুভ মজুমদারের হাতে। “এই গুনীজনদের পুরস্কৃত করতে পেরে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় ধন্য”, এমনটাই জানালেন উপাচার্য অধ্যাপক শিবাজী প্রতিম বসু। ছিলেন, নিবন্ধক ড. জয়ন্ত কিশোর নন্দী, বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সত্যজিৎ সাহা, কলা ও বানিজ্য বিভাগের অধ্যক্ষ অধ্যাপক তপন কুমার দে এবং অধ্যাপক চিত্ত পান্ডা প্রমুখ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ৬০ বছর ধরে বাংলা নাট্যজগতকে তাঁর সৃষ্টি ও অভিনয় দিয়ে সমৃদ্ধ করে তোলা নাট্যকার গৌতম মুখোপাধ্যায়ের লড়াইটা শুরু হয়েছিল একটু অন্যভাবে। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’ অবলম্বনে ‘মা’ নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার ঠিক আগেই মা-এর চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল যে অভিনেত্রীর, তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন! এরপর, চ্যালেঞ্জটা নিয়েই ফেলেন নাট্যকার শম্ভু মিত্রের সুযোগ্য ছাত্র (তথা শিষ্য) গৌতম মুখোপাধ্যায়। মা’এর চরিত্রে তাঁর অসামান্য অভিনয় দর্শকদের বুঝতেই দেয়নি অভিনয় যিনি করলেন, তিনি নারী না পুরুষ! সেই থেকে ৩৯-টি নারী চরিত্রে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যশিল্পী গৌতম মুখোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার বিদ্যাসাগর পুরস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “মা একটা- ধারনা, অবলম্বন! নারী হওয়াটা জরুরি নয়, মাতৃত্বের অনুভূতিটা থাকা দরকার।” হৃদয়ে বেগম রোকেয়া আর আশাপূর্ণা দেবী-কে লালন করে, শৈশব থেকেই মুসলিম সমাজে ‘নারী’র সংজ্ঞাটা বদলে দেওয়ার স্বপ্ন যিনি দেখতেন, ‘মেদিনীপুরের ভূমিকন্যা’ সেই রোশেনারা খান-ও এবার ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ এ ভূষিত হলেন।

thebengalpost.net
স্বীকৃতির মঞ্চে:

১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত এক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেও; প্রথা ভেঙে পড়াশোনা, আবৃত্তি, লেখালেখি করতেন রোশেনারা। সামাজিক চাপে তাঁর বাবা ১৩ বছর বয়সে (অষ্টম শ্রেণীতে) বিয়ে দিতে বাধ্য হলেও, অদম্য জেদ আর ‘শিক্ষক’ স্বামীর অনুপ্রেরণায় ১৯৭৩ সালে স্কুল ফাইনাল (মাধ্যমিক) পাস করেন তিনি। ঠিক একইভাবে ১৭ বছর বয়সে মা হয়েও, নিজের সাহিত্য সাধনা আর প্রতিবাদী প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে মুসলিম মেয়েদের ‘অধিকার আদায়’ এর লড়াই চালিয়ে গেছেন রোশেনারা। তিনি মনে করেন, ধর্মীয় আইন বলে কিছু হয়না! ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ হাতে নিয়ে রোশেনারা বললেন, “দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। অধিকার সুরক্ষিত রাখার লড়াই চলবে। ২০১৪ সালে ছেলেকে হারিয়েছি, ২০২০ সালে স্বামীকে! একমাত্র মেয়ে ইংল্যান্ডে। এখন এই কলম-টাই আমার একমাত্র সঙ্গী। সৃষ্টির মধ্য দিয়েই সমাজের প্রতি কর্তব্য পালন করে যেতে চাই!” ২০০৬ সালে ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ (‘ধ্রুবপুত্র’ উপন্যাসের জন্য) এ ভূষিত অমর মিত্র লড়াইটাও ব্যতিক্রমী! রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করেও, ভূমি সংস্কার দপ্তরের আধিকারিক হিসেবে প্রশাসনিক কাজ করেও, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অমর মিত্র। সাহিত্য অ্যাকাডেমি ছাড়াও ‘বঙ্কিম পুরস্কার’, ‘ও হেনরি’ পুরস্কারে ভূষিত সত্তরোর্ধ্ব এই সাহিত্যিক বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “পূর্ববঙ্গে জন্মগ্রহণ করলেও, পরবর্তী সময়ে ভূমি সংস্কার দপ্তরের আধিকারিক হিসেবে ঝাড়গ্রাম, গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রাম সহ অবিভক্ত মেদিনীপুরেই কেটেছে অনেকটা সময়। মেদিনীপুর থেকেই লেখালেখির শুরু। আমি আমার হারানো পরিবার ফিরে পেয়েছি মেদিনীপুরে!”

thebengalpost.net
স্বীকৃতির মঞ্চে: