মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২ ডিসেম্বর:”আমরা টুটাব তিমির রাত, বাধার বিন্ধ্যাচল….আমরা দানিব নূতন প্রাণ, বাহুতে নবীন বল….চল চল চল।” সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে প্রতিমুহূর্তে এগিয়ে চলেছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যেই অন্যতম পশ্চিম মেদিনীপুরের ‘গর্ব’ বিলু পাত্র, মন্দিরা দাস-কে সম্মানিত করবে রাজ্য সরকার। আগামীকাল (৩ ডিসেম্বর) ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’ (International Day of Persons with Disabilities) উপলক্ষে, জীবনযুদ্ধে ‘জয়ী’ এই বিলু-মন্দিরা’দের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে রাজ্য সরকারের নারী ও শিশু উন্নয়ন এবং সমাজ কল্যাণ দপ্তরের পক্ষ থেকে। একইসঙ্গে, পুরস্কৃত হবে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা শহর মেদিনীপুরে অবস্থিত প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘মিডনাপুর রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার ফর চিল্ড্রেন’ (MRCC)ও। এবার, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা থেকে একমাত্র এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই পুরস্কৃত হতে চলেছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ডেবরা’র চক কৃপাণ এলাকার বাসিন্দা বিলু এখন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রশিক্ষক। স্বভাবতই খুশির হাওয়া এখন মেদিনীপুর শহরের এমআরসিসি-জুড়ে!
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বছর ৩০ এর যুবক বিলু পাত্র জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার! তবে, তাঁর মানসিক শক্তি এতখানি যে, ‘দিব্যাঙ্গ’ (বা, বিকলাঙ্গ) পা জোড়া নিয়েই তিনি যেকোনো সাধারণ মানুষের থেকে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারেন! যদিও, রাস্তাঘাটে বেরোনোর সময় বিলু এখন ট্রাইসাইকেল ব্যবহার করেন। জীবন যুদ্ধে, কোন প্রতিকূলতাই তাঁকে রুখে দিতে পারেনি! ডেবরা থানার পুরুষোত্তম এলাকার চক কৃপাণ গ্রামের বাসিন্দা বিলু একে একে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর, পাঁশকুড়া কলেজ থেকে ভূগোল বিষয়ে স্নাতক (বিএ) সম্পূর্ণ করেছেন। এরপর, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেছেন স্নাতকোত্তর (এমএ)। নিয়েছেন বি.এড প্রশিক্ষণও। স্বপ্ন দেখেন শিক্ষক হওয়ার। বাবা প্রয়াত হয়েছেন, মা ও ভাই-কে নিয়ে সংসার! সংসারের বড় ভরসা বিলু। তাই, গৃহ শিক্ষকতা এবং এমআরসিসি কলেজের প্রশিক্ষক হিসেবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন! শুধু নিজের লড়াই নয়, বিলু এখন শত শত প্রতিবন্ধী শিশু, কিশোর-কিশোরীদেরও লড়াইয়ের মন্ত্র শেখাচ্ছেন। তবে, শুধু শিক্ষকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বিলুর জীবন! ডেবরার ‘আশার আলো হ্যান্ডিক্যাপ সোসাইটি’র অন্যতম সদস্য বিলু একজন সমাজকর্মী হিসেবেও সুবিদিত। নিজের সমস্ত শারীরিক প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে, অতিমারীর দিনগুলিতে বিলু পৌঁছে গিয়েছিলেন ডেবরার একাধিক অসহায় পরিবারের কাছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের ‘গর্ব’ সেই বিলু পাত্র-ই আগামীকাল রাজ্য-রাজধানীর মঞ্চে সম্মানিত হবেন!
পুরস্কৃত হবেন নারায়ণগড় ব্লকের (বেলদা থানা) খাকুড়দা সংলগ্ন বাবলা গ্রামের মন্দিরা দাস-ও। জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন মন্দিরা তাঁর সংগীতের সুর-মাধুর্যে মাতিয়ে রাখেন এলাকা। সংগীতশিল্পী হিসেবে এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন মন্দিরা! চালিয়ে যাচ্ছেন লড়াই। আর, তাঁর এই লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েই তাঁকে সম্মানিত করবে রাজ্য সরকার। আর, এরকমই শত শত বিলু-মন্দিরা তৈরি করার শপথ নিয়ে গত ৪০ বছর ধরে যে প্রতিষ্ঠান ‘চরৈবেতি’ মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে, সেই ‘মেদিনীপুর রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার ফর চিল্ড্রেন’ কেও একই মঞ্চে সম্মানিত করা হবে। তুলে দেওয়া হবে পুরস্কার। প্রয়াত অধ্যাপক শ্যামাপদ পাল প্রতিষ্ঠিত (১৯৮১ সালে) এই প্রতিবন্ধী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন শহরের পালবাড়ি এলাকায় নানা শাখায় বর্ধিত হয়েছে। আবাসিক এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী অবধি পড়ানো হয়। তারপর অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, নেতাজী সুভাষ ওপেন ইউনিভার্সিটির অধীনে এখানে পড়ানো হয় স্পেশাল বিএড (BEd) ও স্পেশাল ডিএলএড (D.El.Ed)। কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, জীবন গড়ে দেওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয় বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন শিশুদের। নাচ, গান, অঙ্কন, আবৃত্তি, ব্রতচারী, খেলাধুলা থেকে শুরু করে ধূপ তৈরি, মোমবাতি তৈরি, পাপোশ তৈরি প্রভৃতিও শেখানো হয়। অতিমারী আর সরকারি বিধিনিষেধের কারণে, গত প্রায় ২ বছর ধরে বন্ধ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি অবধি ক্লাস ও হোস্টেল। তবে, আগামীকাল বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসের অনুষ্ঠান উপলক্ষে, ছাত্র-ছাত্রীরা কোভিড বিধি মেনে নাচগানের মহড়া দিতে ব্যস্ত। দেখে মনে হওয়ার উপায় নেই, এরা কোন অংশে শারীরিকভাবে একশো শতাংশ সুস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের তুলনায় পিছিয়ে! বর্তমানে, এই এমআরসিসি প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক ডেবরার অমিত পাল। তিনি ডেবরায় অবস্থিত ‘আশার আলো হ্যান্ডিক্যাপ সোসাইটি’রও প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি বললেন, “বিলু’র মতো যুবকরা শুধু জেলার নয়, এই দেশের গর্ব! বিলু-মন্দিরা’দের মতো অসংখ্য উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য।” আর, এমআরসিসি’র প্রধান শিক্ষক অরূপ ধাড়া বললেন, “কে বলেছে এরা কোন অংশে পিছিয়ে! এরা বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন। এদের ঐশ্বরিক প্রতিভা আছে, শুধু তা বের করে আনতে হবে। সেই লক্ষ্যে পশ্চিম মেদিনীপুরের এমআরসিসি এবং তার শিক্ষক শিক্ষিকারা অবিচল। আমাদের লড়াইকে স্বীকৃতি জানানোর জন্য রাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ। দায়িত্ব আরও বেড়ে গেলো। আন্তরিক ভাবে সেই দায়িত্ব পালন করাই আমাদের কর্তব্য।”