তনুপ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২ জুলাই: উচ্চ মাধ্যমিক পাস ছাত্রী’র নামে ‘বদনাম’ ছড়িয়ে, তাঁকে এবং তাঁর মা-কে শাসকদলের (তৃণমূল কংগ্রেসের) পার্টি অফিসে ডেকে অপমানিত করার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আত্মঘাতী হয় ওই ছাত্রী! বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) সকালে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার নন্দনপুর ১ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের সেকেন্দারি বাজার থেকে জয়কৃষ্ণপুর যাওয়ার রাস্তার পাশে গাছের ডাল থেকে উদ্ধার হয় মণিদীপা মন্ডল নামে বছর ১৮’র ওই ছাত্রীর ঝুলন্ত দেহ! ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন, মণিদীপা’রই এক কাকিমা। বেঙ্গল পোস্ট ডিজিটাল মাধ্যমেই সবার আগে ওই খবর প্রকাশিত হয়। এরপরই নড়েচড়ে বসে দাসপুর থানার পুলিশ। মণিদীপা’র বাবা, সৌলান গ্রামের বাসিন্দা অমল কুমার মন্ডলের অভিযোগের ভিত্তিতে শনিবার দুপুরে গ্রেপ্তার হয়েছে মণিদীপা’র কাকিমা ঝুমা মন্ডল (২৯)-কে। আদালত তার ২ দিনের পুলিশ হেফাজত মঞ্জুর করেছে। অপরদিকে, সালিশি সভা বসানোর ঘটনায় অভিযুক্ত সৌলান গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য সহ তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধেও নিন্দার ঝড় উঠেছে সর্বত্র। একবিংশ শতকেও এই ধরনের সামন্ততান্ত্রিক সালিশি সভা কেন? শাসকদলের ঘাটাল সাংগঠনিক জেলার সভাপতি আশিস হুদাইত জানিয়েছেন, “বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব। যদি এই ধরনের ঘটনা ঘটে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়।” একই কথা জানিয়েছেন, জেলার জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক কর্মাধ্যক্ষ শ্যামপদ পাত্র-ও। “এই ধরনের ঘটনা একেবারে বিচ্ছিন্ন এবং অনভিপ্রেত”, বলে মত দিয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার সাত সকালে গ্রামবাসীরা দেখেন, গাছের অনেকটা উঁচুতে বাঁধা ওড়না থেকে ঝুলছেন ওই কিশোরী। দাসপুর থানার পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে। জানা যায়, মৃত কিশোরী সৌলান গ্রামের বাসিন্দা অমল কুমার মন্ডলের মেয়ে। পেশায় স্বর্ণ শিল্পী অমল বাবু মুম্বাই-তে থাকতেন। এই খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। তারপরই শুক্রবার মেয়ের শেষকৃত্যের পর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন, কাকিমা ঝুমা মন্ডল, পঞ্চায়েত সদস্য বাবলু দাস, বুথ সভাপতি তপন পাত্র- প্রমুখদের বিরুদ্ধে। শনিবার মূল অভিযুক্ত ঝুমা মন্ডল-কে মহকুমা পুলিশ আধিকারিক (SDPO) অগ্নিশ্বর চৌধুরী’র নির্দেশে গ্রেপ্তার করেছে দাসপুর থানা। তদন্তের স্বার্থে তাঁকে নিজেদের হেফাজতে চায় পুলিশ। আদালত ২ দিনের পুলিশ হেফাজত মঞ্জুর করেছে। মণিদীপা’র বাবা অমল কুমার মন্ডল বুকে পাথর চাপা দিয়ে শনিবার জানিয়েছেন, “আমি বাইরে কাজ করি। মেয়ে আর তার মা থাকে। এবার-ই মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। নিজের পড়াশোনা নিয়েই থাকে। দু’চারদিন আগে পড়াশোনার বিষয় নিয়েই এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিল গ্রামের একটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে। তারপরই ওর কাকিমা অপমান করে, নোংরা কথা বলে। আমার মেয়ে তার প্রতিবাদ করায়, সালিশি সভা’র ডাক দেওয়া হয় (বুধবার সন্ধ্যায়)। সেখানে আমার মেয়েকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। অকারণে, বদনাম ছড়ানো আর এই ধরনের অপমান আমার মেয়ে সহ্য করতে পারেনি। বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। বৃহস্পতিবার সকালে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।” তিনি এও যোগ করেন, “আমার অনুপস্থিতিতে আমার ভাই (পরিমল মন্ডল) আর তার বউ (অভিযুক্ত কাকিমা ঝুমা মন্ডল), আমার স্ত্রী আর মেয়ের উপর প্রায়ই মানসিক নির্যাতন চালাত। যার চরম পরিণতি আমি আমার মেয়েকে চিরতরে হারিয়ে ফেললাম!” এরপরই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কথা বলার অবস্থাতে নেই তাঁর স্ত্রী-ও। শুধু জানালেন, “বিনা অপরাধে বদনাম দেওয়া আর সালিশি সভা’র অপমান মেয়েটা সহ্য করতে পারলনা!” দাসপুরের হাটসরবেড়িয়া উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এবার-ই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে মণিদীপা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বৃন্দাবন ঘটক বলেন, “আমাদের খুব প্রিয় ছাত্রী ছিল মণিদীপা। আমরা মেনে নিতে পারছিনা এই ঘটনা!”
অন্যদিকে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনা ১ নম্বর ব্লকের মনোহরপুর ২ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের কুলদহ গ্রামে, এক গৃহবধূর সাথে এক যুবকের পরকীয়ার অভিযোগ তুলে, শুক্রবার রাতভর বিদ্যুতের খুঁটিতে বেঁধে মারধরের ঘটনাতেও শনিবার একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পরকীয়া ঘটনায় ওই গৃহব ও তাঁর প্রেমিককে বিদ্যুতের খুঁটিতে বেঁধে রেখে রাতভর নির্মমভাবে মারধর করার ঘটনা বা মধ্যযুগীয় বর্বরতার ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরই নড়েচড়ে বসে পুলিশ। কার্তিক কারক নামে এক গ্রামবাসীকে শনিবার গ্রেপ্তার করে ক্ষীরপাই ফাঁড়ির পুলিশ। আগামীকাল তাকে আদালতে তোলা হবে বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রায় ১২ ঘন্টা নির্মমভাবে অত্যাচারিত হওয়ার পর শনিবার সাতসকালে ওই গৃহবধূ ও যুবককে উদ্ধার করে, হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। তারপরই একজনকে গ্রেফতার করা হয়। এই নিন্দনীয় ঘটনা প্রসঙ্গে সমাজকর্মীর একযোগে জানিয়েছেন, “এই ধরনের ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতা ছাড়া কিছুই নয়! প্রেম বা পরকীয়ার শাস্তি এরকম হতে পারেনা! অসামাজিক কোনো কিছুর প্রতিবাদ হতে পারে, পুলিশ-প্রশাসনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু, আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে এই ধরনের নির্যাতন চালানো ক্ষমার অযোগ্য!”