মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৮ মার্চ: ঠিক তিন মাসের মাথায় মেদিনীপুর শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত গোপগড় ইকোপার্কে (Gopegarh Ecopark) প্রবেশ করলো দলছুট দাঁতাল। গত ২৭ ডিসেম্বর (২০২২) সন্ধ্যার পর আজ, মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) সকালে। গত কয়েকদিন ধরে মেদিনীপুর ও খড়্গপুর বনবিভাগের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক জনকে হত্যা করা এবং আহত করা সেই হিংস্র হাতিটিই গোপগড় ইকোপার্কে প্রবেশ করে বলে বনদপ্তরের প্রাথমিক অনুমান। সোমবার সকাল যে হাতিটি ভাদুতলা রেঞ্জে এক মহিলাকে এবং এক যুবকের উপর হামলা চালিয়েছিল, সেটিকেই বনদপ্তরের তরফে লোকালয় থেকে জঙ্গলে পাঠানোর চেষ্টা চলছিল। মঙ্গলবার সকাল দশটা নাগাদ সেই হিংস্র হাতিটিই প্রবেশ করে একেবারে পার্কের মধ্যে। এরপরই, মেদিনীপুর রেঞ্জ, গোপগড় রেঞ্জ সহ মেদিনীপুর বনবিভাগের তরফে হাতিটিকে ট্রাঙ্কুলাইজার (Tranquilizer) দিয়ে বাগে আনা বা ঘুম পাড়ানোর (Tranquilize) উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর, এই পুরো বিষয়টিতে সামনে থেকে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি মেদিনীপুর রেঞ্জের রেঞ্জ অফিসার তথা সকলের প্রিয় বনাধিকারিক পাপন মোহান্ত। মঙ্গলবার দুপুরে তাঁর উপরই পাল্টা হামলা চালায় হিংস্র হাতিটি! তবে, অত্যন্ত তৎপরতার সাথে নিজেকে কোন মতে মৃত্যু-মুখ থেকে বাঁচিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন দক্ষ এই বনাঞ্চল আধিকারিক। গুরুতর আহত অবস্থায় এই মুহূর্তে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি।
প্রসঙ্গত, এই ট্রাঙ্কুলাইজ করার বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ ফরেস্ট অফিসার হিসেবে পরিচিত পাপন মোহান্ত। গত কয়েক বছর মেদিনীপুর থেকে শুরু করে ঝাড়গ্রাম বনবিভাগে অন্তত ৮-১০টি এরকম ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বাগে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন লোকালয়ে প্রবেশ করা কিংবা হিংস্র দাঁতালকে। তবে, এবার হয়তো ভাগ্য কিছুটা বিরূপ ছিল! তাই, জখম হতে হল তাঁকে। জানা যায়, মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে ট্রাঙ্কুলাইজ করার কাজ শুরু হয়েছিল। পার্কের মধ্যে প্রবেশ করা পর্যটকদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়। পুরো অভিযান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উপস্থিত ছিলেন সিসিএফ (Chief Conservation of Forest) কে.পি সিং থেকে ডি.এফ.ও (DFO) সন্দীপ বেরোয়াল থেকে এডিএফও’রা। তবে, তাঁরা ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে থাকলেও; হিংস্র হাতিকে ঝোপ-জঙ্গল থেকে খুঁজে বের করে ট্রাঙ্কুলাইজ করার কাজে নেমেছিলেন একাধিক রেঞ্জ অফিসার, বিট অফিসার সহ বনকর্মী ও হুলা পার্টির সদস্যরা। আর, তা করতে গিয়েই ওই হিংস্র হাতির হামলার মুখে পড়েন মেদিনীপুরের রেঞ্জ অফিসার পাপন মোহান্ত। তাঁর কোমরে ও হাতে মারাত্মক চোট লেগেছে। তবে, অবস্থা স্থিতিশীল। মেদিনীপুর মেডিক্যালে তাঁর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এদিকে, মঙ্গলবার বেলা তিনটা অবধি গোপগড় ইকোপার্কে হাতিটিকে বাগে আনা যায়নি! শেষ পর্যন্ত, আরও বনকর্মী ও হুলা পার্টির সদস্য বাড়িয়ে বেলা সাড়ে তিনটা নাগাদ হিংস্র হাতিটিকে ট্রাঙ্কুলাইজ করা সম্ভব হয়েছে বলে বনদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অবজার্ভেশন রুমে শুয়ে খোদ পাপন মোহান্ত তাঁর মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসার যে বিবরণ দিয়েছেন, তা হল- “হাতিটি শুধু আমাকেই এদিন তিন-তিনবার আক্রমণ করে। প্রথম দু’বার কোনো মতে বেঁচে যাই। তৃতীয় বার নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে পড়ে যাই। আমার উপর পড়ে হাতিটিও। এরপর, দাঁত দিয়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করলে, আমি শরীরের প্রাণপণ শক্তি দিয়ে ওর শুঁড়-টা চেপে ধরি! তবে, এই সবটাই সম্ভব হয়েছিল হাতিটির বয়স অত্যন্ত কম (৭-৮বছরের মধ্যে) বলে। নাহলে আমাকে এই সুযোগই দিতো না, পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলত! তবে, একটা সময় মনে হয়েছিল, আর বেঁচে ফিরতে পারবোনা! ঈশ্বরের অসীম কৃপায় আজ বেঁচে ফিরলাম।” রীতিমতো কাঁপতে কাঁপতে কথাগুলো বললেন ‘যুদ্ধ জয়ী’ পাপন। গোটা শরীরে তখন তাঁর তীব্র যন্ত্রণা আর ক্ষতবিক্ষত হওয়ার চিহ্নের থেকেও বেশি করে ফুটে উঠছিল একেবারে সামনে থেকে ‘মৃত্যু’-কে প্রত্যক্ষ করার অবর্ণনীয় আতঙ্ক!