মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৫ ফেব্রুয়ারি: “বিপদে আমি না যেন করি ভয়…দুঃখে যেন করিতে পারি জয়!” কবির (রবি ঠাকুরের) এই চিরন্তন বাণীই কি সেদিন প্রিয় ছাত্রের অন্তরে গেঁথে দিয়েছিলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক? পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গল অধ্যুষিত শালবনী ব্লকের মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক ড. প্রসূন কুমার পড়িয়া শনিবার বিকেলে বলেন, “কবির বাণী হয়তো সেই মুহূর্তে উচ্চারণ করার সুযোগ বা পরিস্থিতি ছিলো না! কারণ, সবথেকে কঠিন সত্য-টা সেদিন আমাকেই শোনাতে হয়েছিল আমাদের ছাত্র’কে। বিমল (বিমল মান্ডি) তখনও জানতো না, ওর বাবা (হাতির হামলায় মৃত টুকেশ্বর মান্ডি) আর এই পৃথিবীতে নেই! ওকে বলা হয়েছিল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি আছেন। কিন্তু, শোক-সংবাদটা ওকে শোনাতেই হতো। কারণ, ওই দিন আর কয়েক ঘণ্টা পরই মেদিনীপুর মেডিক্যাল থেকে (ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়ে) দেহ বাড়িতে পৌঁছনোর কথা ছিল। তাই নিজেকে ‘শক্ত’ করে, ছাত্র বিমল-কে বলেছিলাম, ‘বাবা তোমাকে শক্ত হতে হবে। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। মনের জোরে উচ্চ মাধ্যমিকের বাকি পরীক্ষাগুলো তোমাকে দিতে হবে। নাহলে কিন্তু, তোমার বাবার আত্মা শান্তি পাবেনা!’ ও শুধু প্রশ্ন করেছিল, ‘স্যার, বাবা কি তাহলে আর নেই?’ এরপর, যা সত্য তাই ওকে বলেছিলাম।”
প্রধান শিক্ষকের কথা রেখেছে বিমল। শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে, শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ‘পিতৃশোক’ বুকে নিয়েই উচ্চ মাধ্যমিকের সংস্কৃত পরীক্ষা দিয়েছে মৌপাল স্কুলের কলা বিভাগের (আর্টসের) উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তথা শালবনী ব্লকের কালিবাসা গ্রামের বিমল মান্ডি। গত বুধবার অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ৪টি দলছুট দাঁতালের ভয়াবহ আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছিলেন বিমলের বাবা তথা কালিবাসা গ্রামের বছর ৫০’র কৃষক টুকেশ্বর মান্ডি। ঘটনাস্থলে গুরুতর জখম হওয়ার পর, দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করে পাঠানো হয়েছিল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। তবে, পৌঁছনোর পরই চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন। মর্মান্তিক সেই মৃত্যু-সংবাদ সেই রাতে শোনানো হয়নি তাঁর ছোটো ছেলে বিমল-কে! কারণ, পরদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সকালেই বিমলের উচ্চ মাধ্যমিকের ‘স্বাস্থ্য ও শারীরশিক্ষা’ বিষয়ক পরীক্ষা ছিল। তাই দাদা সিমল সহ পরিবারের সদস্যরা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বিমলকে বলা হয়েছিল, বাবা (টুকেশ্বর মান্ডি) মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি আছেন!
বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) যথারীতি নিজের পরীক্ষাকেন্দ্র পিড়াকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয় বিমল। পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে বেরোনোর পর সেই ‘কঠিনতম’ কাজটি করতে হয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককেই! প্রসূন বাবু বলেন, “ছেলেকে বাবার মৃত্যু-সংবাদ শোনানো! সত্যিই বড় কঠিন কাজ। তবে নির্মম সত্যটা ওকে তো শোনাতেই হতো। একইসঙ্গে ওর পাশে থাকা, ওকে মানসিক শক্তি জোগানোর কাজটাও করতে হতো।” শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) অবশ্য ড. প্রসূন কুমার পড়িয়া সহ বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক-শিক্ষিকারাই কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন! বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ময়নাতদন্তের পর কালিবাসার বাড়িতে দেহ পৌঁছয় টুকেশ্বর মান্ডির। শুক্রবার সকালে দাদা সিমলের পাশে থেকে বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে বিমল। ‘পিতৃশোক’ বুকে নিয়েই শনিবার যথারীতি সংস্কৃত বিষয়ের পরীক্ষা দেয় সে। পরীক্ষা মোটের উপর ঠিকঠাক হয়েছে বলেই শিক্ষকদের জানিয়েছে বিমল। আর একটিমাত্র পরীক্ষা (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) তার বাকি আছে। এদিকে, শুক্রবারই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের তরফে বিমলের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে শিশু সুরক্ষা দফতরের এক আধিকারিক ফোন করেছিলেন মৌপাল স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রসূন কুমার পড়িয়া-কে। প্রশাসনের তরফে সমস্ত ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ড. পড়িয়া। এর মধ্যেই অবশ্য বনদপ্তরের তরফেও পরিবারের হাতে ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দেওয়া হয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, পরিবারের একজন সদস্যকে চাকরির প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।