দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, ২৪ আগস্ট: ২৩ আগস্ট (বুধবার) সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছে ভারত (India)। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের দক্ষিণ মেরু ছুঁয়েছে ভারতের বীর ‘বিক্রম’। এবার, ল্যান্ডার বিক্রমের পেটে থাকা ‘প্রজ্ঞান’ তার কাজ শুরু করবে। সে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর ছবি তুলে পাঠাবে ইসরো-র বিজ্ঞানীদের কাছে। চাঁদের মাটি, খনিজ, জলের খোঁজ করবে প্রজ্ঞান। আগামী দিনে বিশ্বের কাছে নতুন দিক খুলে দেবে ভারতের এই সাফল্য! তবে, এই সাফল্য সহজে আসেনি। গত কয়েক মাস কিংবা কয়েক বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ইসরো-র বিজ্ঞানীরা এই সাফল্য ছিনিয়ে এনেছেন। আর, সেই তালিকাতে উজ্জ্বল বাঙালি বিজ্ঞানীরাও! বাংলার ‘নবগ্রহ’ (অন্তত ৯ জন তরুণ বিজ্ঞানী) চন্দ্রযান-৩ অভিযানে অবদান রেখেছেন বা সরাসরি যুক্ত আছেন। এঁরা হলেন যথাক্রমে- বাঁকুড়ার কৃশানু নন্দী, পূর্ব মেদিনীপুরের পীযূষকান্তি পট্টনায়েক, উত্তর চব্বিশ পরগনার জয়ন্ত পাল, হুগলির জয়ন্ত লাহা, উত্তর দিনাজপুরের অনুজ নন্দী, মুর্শিদাবাদের তুষার কান্তি দাস, জলপাইগুড়ির কৌশিক নাগ এবং বীরভূমের বিজয় দাই ও সৌম্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়।
পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার ঘোষপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার উত্তর কাঁটাল গ্রামের বছর ৩১-র পীযূষ ২০১৫ সালে ইসরো’তে যোগ দেন। তিনি চন্দ্রযান-২ অভিযানের সময়ও যানের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন। এবার সেই একই দায়িত্ব পালন করেছেন এবং যানের সফল অবতরণের পরে গর্ব বোধ করছেন। চন্দ্রযান-৩ অভিযানে পীযূষের যুক্ত থাকার খবর সামনে আসার পর তাঁর বাড়ির এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। আশা ও উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন দশেক আগেই বেঙ্গালুরুতে ছেলের বাসায় পৌঁছে গিয়েছিলেন পীযূষের বাবা ও মা। সেখানে স্ত্রী ঐন্দ্রিলা-কে নিয়ে থাকেন পীযূষ। পীযূষের বাবা রাধাকান্ত পট্টনায়ক সেচ দফতরের অবসর প্রাপ্ত কর্মী। মা অনিমা গৃহবধূ। বুধবার সন্ধ্যা ৬-টা ৪ মিনিট বাজার পরই ইসরো-র কন্ট্রোলরুমে উৎসব শুরু হয়ে যায়। কল্যাণী সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বি.টেক করার পর আইআইটি খড়্গপুর (IIT Kharagpur) থেকে এম.টেক সম্পূর্ণ করা পীযূষ বলেন, “সবাই বন্দেমাতরম, ভারত মাতা কি জয় স্লোগান দিচ্ছেন। তবে আমাদের কাজ এখনও শেষ হয়নি। বিক্রম এখন আমাদের ছবি তুলে পাঠাবে। অবতরণের ঘণ্টা তিনেক পর বিক্রমের পেট থেকে রোভার প্রজ্ঞানকে বের করতে হবে। প্রজ্ঞানের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার দায়িত্ব আমাদের।”
বাঁকুড়ার পাত্রসায়রের কৃষক পরিবারের ছেলে কৃশানু নন্দীর স্কুল থেকে ইসরো পর্যন্ত যাত্রাপথ বেশ কঠিন। তাঁর দিদি দেবিকা নায়েক বলছিলেন, কখনও ছাত্র পড়িয়ে, কখনও মেধাবৃত্তির টাকা থেকে ভাইয়ের পড়ার খরচ জুগিয়েছেন তিনি। জামাইবাবু শৌভিক নায়েক বলেন, ‘‘মঙ্গলবার থেকে অফিসেই রয়েছে কৃশানু। ওর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।’’ কৃশানুর বাবা-মা চিকিৎসার জন্য এখন বেঙ্গালুরুতেই আছেন। বাড়িতে রয়েছেন কৃশানুর কাকীমা এবং কৃষানুর জেঠুর ছেলে। চন্দ্রযানের কর্মযজ্ঞে ভীষণ ব্যস্ততার কারণে সংযোগ স্থাপন পর্যন্ত করা যায়নি যাদবপুরের (Jadavpur University) প্রাক্তনী কৃষাণু নন্দীর সঙ্গে। দিদি দেবিকার কথায়, ‘‘এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’’
মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বড়ুয়া কলোনির একটি দোতলা বাড়ির সামনে তো সন্ধ্যায় বাজি ফাটানো শুরু হয়ে যায়। এই বাড়ির ছেলে তুষারকান্তি দাস ইসরোর বিজ্ঞানী। আইআইটি খড়্গপুরের (IIT Kharagpur) প্রাক্তনী সরাসরি চন্দ্রযান-৩ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। চন্দ্রযানের চাঁদের মাটি ছোঁয়া তাই যেন গোটা মহল্লার গর্বের দিন। তুষারের বন্ধু অরিন্দম ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘‘ও বরাবরই পড়ুয়া ছেলে। এখন তো চাঁদও ছুঁয়ে ফেলল!’’ তুষারের দাদা কুমারকান্তি হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘ভাইয়ের আলোয় আমরাও যেন এখন ছোটখাট সেলিব্রিটি!’’ একই রকম উচ্ছ্বাস উত্তর দিনাজপুরে ইসলামপুরে, আশ্রমপাড়ায় অনুজ নন্দীর বাড়িতে। অনুজ চন্দ্রযানের অভিযানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁর মা শোভারানি নন্দী বলেন, ‘‘জানতাম, ছেলের পরিশ্রম সফল হবে।’’ অনুজের ভাইপো অরিত্র টিভির সামনে থেকে উঠতেই চাইছিল না। পরে সে বলল, ‘‘জেঠুর সাফল্য দেশকে গর্বিত করেছে। আমিও চেষ্টা করব, জেঠুর মতো হতে।’’ উল্লেখ্য যে, অনুজও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (Jadavpur University) প্রাক্তনী। পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করার পর এম.টেক ও পিএইচডি করেছেন।
চন্দ্রযান-৩ এর গতিবেগ কেমন হবে তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন উত্তর চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়ার ‘তরুণ বিজ্ঞানী’ জয়ন্ত পাল। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে ২০১০ সালে তেঁতুলিয়া উচ্চতর হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৭৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেন জয়ন্ত। জয়েন্টে ভাল ফল করলেও অর্থের অভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হয়নি। অঙ্ক নিয়ে জয়ন্ত বারাসত সরকারি কলেজে ভর্তি হন। পরে খড়্গপুর আইআইটি (IIT Kharagpur) থেকে এমএস (MS) করেন। সেখানেই সদ্য পিএইচডি শেষ করেছেন। তার আগেই ২০১৮ সাল থেকে ইসরো-র বিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করছেন বাদুড়িয়ার ‘ভূমিপুত্র’ বছর ৩১-র জয়ন্ত। অপরদিকে, চন্দ্রযান ৩-এর নেভিগেশন বা ক্যামেরা সিস্টেম তৈরিতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন হুগলি জেলার উত্তরপাড়ার বাসিন্দা জয়ন্ত লাহা। গত ৯ বছর ধরে ইসরো-তে কর্মরত হুগলির উত্তরপাড়া বি.কে স্ট্রিটের বাসিন্দা জয়ন্ত লাহা। উত্তরপাড়া গভর্মেন্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন জয়ন্ত। শিবপুর কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন তিনি। তারপর কানপুর আইআইটি থেকে পাস করে ২০০৯ সালে ইসরোতে যোগ দেন উত্তরপাড়ার ছেলে। বাবা প্রশান্ত লাহা অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী, মা চন্দনা লাহা গৃহবধূ। চন্দ্রযানের সাফল্যের পর উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় উত্তরপাড়ার মানুষ।
জলপাইগুড়ির কৌশিক নাগ চন্দ্রযান-৩ এর সফটওয়্যার অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত। বছর ৩০’র কৌশিক জলপাইগুড়ি সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়েন। পরে এম.টেক করেন। জলপাইগুড়ি থেকে তাঁর ইসরো-যাত্রা সহজ ছিলোনা! তবে, এখন খুশির হাওয়া জলপাইগুড়ি জেলা জুড়েও। বীরভূমের সিউড়ির সৌম্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় চন্দ্রযান-৩-এর অন্যতম অপারেশন ডিরেক্টর (মিশন সফ্টওয়্যার)। তাঁর বাবা-মাও উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন। চন্দ্র-বিজয়ের পর তাঁরা বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে জীবন সার্থক হল। চন্দ্রযান চাঁদের মাটি ছোঁয়ার মূহূর্তের সাক্ষী থাকতে পেরে গোটা দেশের মানুষের সঙ্গে আমরাও গর্বিত।’’ বীরভূম জেলারই মল্লারপুরের দক্ষিণ গ্রামের বিজয় দাই চন্দ্রযান-৩-এর অন্যতম অপারেশন ডিরেক্টর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.টেক পাস করা বিজয় এর মা শ্যামলী দাই বলেন, ‘‘আমরা টিভির সামনে প্রবল উৎকণ্ঠায় বসেছিলাম। এখন খুব আনন্দ হচ্ছে।’’ তিনি ততক্ষণে শঙ্খ বাজাতে শুরু করেছেন। চন্দ্রযান-২ এর ব্যর্থতা মন ভেঙে দিয়েছিল বিজয়ের বাবা নারায়ণচন্দ্র দাইয়েরও। এ বার তিনিও খুব চিন্তায় ছিলেন। অবশেষে সাফল্য। বুধবারই বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো দেব।’’