দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২২ ডিসেম্বর: খড়্গপুরের ‘খেলা শেষ’! অবশেষে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ চেয়ারম্যান প্রদীপ সরকারকে সরাতে সক্ষম হলেন দলের ২১ জন (২৫ জনের মধ্যে) বিদ্রোহী কাউন্সিলর। পরতে পরতে নাটক আর টানটান উত্তেজনা শেষে, বুধবার সন্ধ্যায় (সাড়ে ৬ টা নাগাদ) প্রদীপ সরকারের ইস্তফা গৃহীত হয়। আর, তার মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই মেদিনীপুর শহরের আনাচেকানাচে যেন শোনা গেল ‘শুভস্য শীঘ্রম’! পৌরসভার চেয়ারম্যান সৌমেন খানের ‘বিরুদ্ধে’ নাকি ইতিমধ্যেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তৃণমূলের ১১ জন কাউন্সিলর (২০ জনের মধ্যে)। এতদিন যা ছিল আড়ালে, আবডালে; বুধবার সন্ধ্যার পর তা যেন চলে এলো প্রকাশ্যে! জানা গেল, ইতিমধ্যেই তৃণমূলের ২০ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ১১ জন কাউন্সিলরের সই করা একটি ‘অভিযোগপত্র’ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্য নেতৃত্বের কাছে। সূত্রের খবর, সেই চিঠি নাকি পৌঁছেছে এই মুহূর্তে দলের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও। আর, জেলা নেতাদের কাছে তো গত কয়েকমাস ধরেই অভিযোগ জানাচ্ছিলেন এই ১১ জন কাউন্সিলর। তবে, বুধবার সন্ধ্যায় এও জানা গেছে, কেবল এই ১১ জন নয়, আরও ৩-৪ জন কাউন্সিলরও নাকি চেয়ারম্যানের কাজকর্মে সন্তুষ্ট নন। তাঁরাও এই ১১ জনের দলে ভিড়তে চাইছেন! ঠিক যেমন খড়্গপুর পৌরসভার ক্ষেত্রে বিদ্রোহী কাউন্সিলদের সংখ্যাটা ১৮ থেকে বাড়তে বাড়তে ২১ এ পৌঁছে গিয়েছিল, মেদিনীপুর পৌরসভার ক্ষেত্রেও নাকি সংখ্যাটা ১৪’য় পৌঁছতে পারে! কোনো কারণে ‘অনাস্থা’ এলে বিরোধী দলের ৫ জন কাউন্সিলর-ও নাকি এই বিদ্রোহী কাউন্সিলদের সঙ্গেই থাকবেন বলে সূত্রের খবর।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মেদিনীপুর পৌরসভায় মোট ২৫ জন কাউন্সিলর। তৃণমূলের ২০ এবং বাকিরা ৫ (সিপিআইএম ৩, কংগ্রেস ১, নির্দল ১)। তৃণমূলের দলীয় সূত্রের খবর অনুযায়ী, মেদিনীপুরের ‘জনপ্রিয়’ বিধায়ক জুন মালিয়া’র ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে গত মার্চ মাসে (২০২২) মেদিনীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে কংগ্রেস থেকে আসা সৌমেন খানের নামেই শিলমোহর দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাইস চেয়ারম্যান, সিআইসি, ইনচার্জ-ও করা হয়েছিল জুন-সৌমেন গোষ্ঠীর ৭-৮ জনকে। এই মুহূর্তে, সেই ৮ জন ছাড়া বাকি ১১ জনই চেয়ারম্যান সৌমেন খানের বিরুদ্ধে। এমনকি, নানা দায়িত্বে থাকা ৮ জনের মধ্যেও ২-৩ জন নাকি গোপনে যোগাযোগ রেখে চলেছেন ‘বিদ্রোহী’ ১১ জনের সঙ্গে! শহরে কানাঘুষো চলে, এই ১১ জন কাউন্সিলর জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা এবং শহর সভাপতি ও ১৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিশ্বনাথ পাণ্ডবের গোষ্ঠীর! বিধায়ক জুন মালিয়া’র বিরোধী গোষ্ঠী হওয়াতে, পৌরসভার প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁদের বঞ্চিত ও অপমানিত হতে হয় বলে অভিযোগ। সেজন্যই, খড়্গপুর পৌরসভার বিদ্রোহী কাউন্সিলদের দেখে ‘উৎসাহিত’ হয়ে তাঁরাও এবার ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেছেন বলে রাজনৈতিক মহলের মত। যদিও, রাজনৈতিক মহলের আরেকটি সূত্র জানাচ্ছে, এই ‘খেলা’র প্লট তৈরি হয়ে গিয়েছিল, ২০ নভেম্বর রাত ১০ টায় অরবিন্দ স্টেডিয়ামের সামনেই! যেদিন, সুজয়-দীনেন-প্রদ্যোৎ’রা বিপুল ব্যবধানে (১৮-২) জিতে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। আর, পরাজিত হয়েছিলেন আশিস চক্রবর্তী, সুব্রত সরকার-রা! ফলাফল ঘোষণার পরই লর্ডসের ব্যালকনিতে সৌরভ গাঙ্গুলী’র মতোই জামা উড়িয়ে জয় উদযাপন করেছিলেন শহর সভাপতি বিশ্বনাথ পাণ্ডব! স্লোগান উঠেছিল, “খেলা শুরু!” পরাজিতদের মধ্যে অনেকেই জুন-সৌমেন অনুগামী ছিলেন বলেই হয়তো এই স্লোগান উঠেছিল, মত শহরের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের!
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বুধবার (২১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ১১ জন বিদ্রোহী কাউন্সিলদের মধ্যে একাধিক কাউন্সিলর চেয়ারম্যান সৌমেন খানের ‘একতরফা’ সিদ্ধান্ত ও কাজকর্মের বিরুদ্ধে রীতিমতো গর্জে ওঠেন। এঁদের মধ্যে টোটোন শাসপিল্লি (১২ নং ওয়ার্ড), লিপি বিষই (১১ নং ওয়ার্ড) এবং ডাঃ গোলোক বিহারী মাজি (৬ নং ওয়ার্ড) প্রমুখ বলেন, ৩-৪ জন কাউন্সিলরের সঙ্গে আলোচনা করেই সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, অনুষ্ঠান করা হয়, খরচ করা হয়। সবকিছু থেকে তাঁদের বঞ্চিত রাখা হয়। এমনকি নিজেদের ওয়ার্ডে পরিষেবা দিতে গিয়েও তাঁদের অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। তাঁদের সমর্থন জানিয়ে, বুধবার রাতে ৮ নং ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা জেলার বিশিষ্ট ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ইন্দ্রজিৎ পানিগ্রাহীও আক্ষেপের সুরে বলেন, “মানুষের ভোটে জিতে, মানুষের জন্য কাজ করব বলে কাউন্সিলর হয়েছি। তা করতে পারছিনা! এমনকি, পৌরসভার এমন অনেক বিষয় আছে, যা আমাদের অন্ধকারে রেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এই সব বিষয়ে আমাদেরকে যখন ওয়ার্ড বাসী জিজ্ঞেস করছেন, আমরা তার সদুত্তর দিতে পারছিনা! আর, বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলোতে তো আমরা ব্রাত্যই থাকি। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান আর ২-৩ জন সিআইসি (চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল)-ই যেন সব! এভাবে অপমান সহ্য করতে হবে ভাবিনি।” উল্লেখ্য যে, মাত্র চার দিন আগে অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর পৌরসভার পুরস্কার বিতরণী ও সম্মাননা জ্ঞাপন অনুষ্ঠানেও যাননি এই ১১ জন তৃণমূল কাউন্সিলর। ইন্দ্রজিৎ অবশ্য জানান, “বিষয়টা ১১-৯ হিসেবে দেখলে ভুল হবে। চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ ৩-৪ জন কাউন্সিলর ছাড়া সবাই তাঁর কাজে ক্ষুব্ধ। এমনকি, বিরোধী দলের ৫ জন কাউন্সিলরকেও যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়না! তাঁদের সঙ্গেও কোনো কিছু আলোচনা করা হয়না।” যদিও, চেয়ারম্যান সৌমেন খানের বক্তব্য, “আমি সকলকে নিয়েই চলার চেষ্টা করি। কোথায় ক্ষোভ সত্যিই আমি বুঝতে পারছিনা।” এদিকে, বিশ্বস্ত সূত্রের খবর অনুযায়ী, টোটোন শাসপিল্লি, লিপি বিষই, ডাঃ গোলোক বিহারী মাজি, ইন্দ্রজিৎ পানিগ্রাহী ছাড়া তৃণমূলের আরও যে ৭ জন কাউন্সিলর সরাসরি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন, তাঁরা হলেন যথাক্রমে- মৌ রায় (৫ নং ওয়ার্ড); মোজাম্মেল হোসেন (১৩ নং ওয়ার্ড); নম্রতা চৌধুরী (১৭ নং ওয়ার্ড); বিশ্বনাথ পাণ্ডব (১৯ নং ওয়ার্ড); প্রতিমা দে (২০ নং ওয়ার্ড); মৌসুমী হাজরা (২২ নং ওয়ার্ড); সত্য পড়িয়া (২৫ নং ওয়ার্ড)। বিশ্বস্ত সূত্র এও বলছে, এখনও অবধি চেয়ারম্যান তথা ১৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৌমেন খানের পক্ষে যাঁরা আছেন, তাঁরা হলেন যথাক্রমে- ১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অনিমা সাহা (ভাইস চেয়ারম্যান); ২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মিতালী ব্যানার্জী (সিআইসি); ৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নিরূপমা কোনার; ৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সীমা ভকত; ৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিপ্লব বসু ওরফে সৌরভ বসু (সিআইসি); ১৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাহুল বিষুই (স্পোর্টস কমিটির ইনচার্জ); ১৬ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুসময় মুখার্জি (সিআইসি) এবং ২৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চন্দ্রানী দাস। এদিকে, খড়্গপুরের পর বিদ্রোহ মেদিনীপুরে! এনিয়ে অস্বস্তিতে তৃণমূল? জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা জানিয়েছেন, “আমাদের দলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। অভাব-অভিযোগ থাকবে। মেদিনীপুর পৌরসভার ক্ষেত্রে কিছু কাউন্সিলদের কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে, খুব শীঘ্রই ভুল বোঝাবুঝি দূর করে দেওয়া হবে! তবে, রাজ্য নেতৃত্বের কাছে কাউন্সিলদের চিঠি পাঠানোর বিষয়টি আপনাদের কাছেই শুনলাম। খোঁজ নেব।”