মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৮ নভেম্বর: ইচ্ছে থাকলে মানুষ কি না করতে পারে! আর, যেখানে ডেডিড ইমানুয়েলেল মতো মহৎ হৃদয়ের যুবকরা থাকেন, সেখানে তো অসাধ্য সাধনও অসম্ভব নয়। গত ১৭ বছর ধরে ঘর হারিয়ে ‘ভবঘুরে’ হয়ে যাওয়া রাজেন্দ্র কোল এর পরিবার ফিরে পাওয়া তো তেমনই এক অসাধ্য সাধনের ‘মানবিক’ কাহিনী! জঙ্গলমহল পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনী ব্লকের একদা মাও অধ্যুষিত পিড়াকাটার সহৃদয় যুবক ডেভিড ইমানুয়েল-এর মানবিক উদ্যোগে, প্রায় ১৭ বছর পর বাড়ি ফিরতে চলেছেন মধ্যপ্রদেশের রাজেন্দ্র কোল। আগামীকাল (বুধবার)-ই হয়তো তাঁর পরিবারের সদস্যরা তাঁকে নিতে পৌঁছে যাবেন পিড়াকাটায়। আজ, মঙ্গলবার, সন্ধ্যা নাগাদ ঠিক তেমনটাই জানা গেছে পুলিশ সূত্রে।

thebengalpost.net
ডেভিডের সঙ্গে রাজেন্দ্র :

ঘটনা সূত্রে জানা গেছে, বছর ৬৫’র রাজেন্দ্র কোল- এর বাড়ি মধ্যপ্রদেশের রাওয়া জেলার পানোয়ার থানায়। প্রায় ১৭ বছর আগে তিনি কাজের খোঁজে বাড়ি থেকে বেরোন। তারপর কোনো কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকেন। ঘুরতে ঘুরতে গত ৩ নভেম্বর (২০২২), বৃহস্পতিবার শালবনী ব্লকের পিড়াকাটায় পৌঁছন। ভবঘুরে ওই ব্যক্তিকে নিজের বাড়ির কাছাকাছি ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে দেখে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন বছর তেইশের যুবক ডেভিড ইমানুয়েল। কথা বলে বুঝতে পারেন, ওই ব্যক্তি ভিন রাজ্যের এবং তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। তারপর ডেভিড তাঁকে নিজের বাড়ি নিয়ে যান এবং বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করেন। এভাবেই, গত ৫ নভেম্বর, শনিবার ইন্টারনেট মারফত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় ওয়েস্ট বেঙ্গল হাম রেডিও ক্লাবের সম্পাদক অম্বরিশ নাগ বিশ্বাসের। অম্বরিশ তাঁর সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ওই ব্যক্তির নাম রাজেন্দ্র কোল। বয়স আনুমানিক ৬৫। বাড়ি মধ্যপ্রদেশের পানোয়ার থানায়। তাঁর বাড়িতে স্ত্রী ও তিন ছেলে আছে। এভাবেই, ডেভিডের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ করিয়ে দেন। তাঁরা নিশ্চিত হওয়ার পর প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং গতকাল, সোমবারই তাঁরা মধ্যপ্রদেশ থেকে রওনা দেন পিড়াকাটার উদ্দেশ্যে। মঙ্গলবার, বিকেল নাগাদ, শালবনী থানা ও পিড়াকাটা পুলিশ পোস্ট সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল অর্থাৎ‌ বুধবার হয়তো রাজেন্দ্র কোল- এর পরিবারের সদস্যরা পিড়াকাটায় পৌঁছে যাবেন।

thebengalpost.net
আগামীকালই বাড়ি ফিরে যাবেন রাজেন্দ্র কোল:

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বছর ২৩ এর ডেভিড স্নাতক পাস করে বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করছেন। বাড়িতে আছেন মা আর ভাই। পেশায় একজন রেলকর্মী ছিলেন বাবা ইউজিন ইমানুয়েল। প্রায় ১৮ বছর আগে তাঁদের ছেড়ে চলে গেছেন! ভাই পিটার ইমানুয়েল অন্যের প্রাইভেট কার (ব্যক্তিগত চার চাকা) চালান। ডেভিডের ইচ্ছে ভালো কিছু করার। পড়াশোনা করেন আর বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন। ভালোবাসেন মানুষের সঙ্গে মিশতে, কথা বলতে। পশু, পাখিদেরও সেবা-শুশ্রূষা করে বেড়ান। একইসঙ্গে মানবপ্রেমিক ও পশুপ্রেমী বলাই যায় তাঁকে! সেই ডেভিড যখন ভবঘুরে রাজেন্দ্র-কে দেখেন, তখনই বিগলিত হয় তাঁর মন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে ডেভিড বলেন, “কেন জানিনা ওনাকে দেখেই আমার খুব ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছিল। ওঁর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা দুঃখ-যন্ত্রণা আমাকে নাড়া দেয়। প্রথমে ওনাকে আমি বিস্কুট ও জল খেতে দিই। উনি ইশারা করে বলেন, তুমিও খাও! এরপরই, ওনাকে আমার আরও ভালো লাগে। আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। দুপুরের খাওয়ার খেতে দিই। আমাদের ইশারা করে বলেন, তোমরা খেয়েছ?” এরপরই, নানা কথাবার্তা বলতে বলতে ডেভিড বুঝতে পারেন বহু বছর ধরে তিনি বাড়ি ছাড়া। হারিয়ে ফেলেছেন মানসিক ভারসাম্য। তারপরই ডেভিডের উদ্যোগ শুরু হয়। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর ডেভিড আর তাঁর মা-ভাইয়ের মুখে এখন খুশির হাসি! প্রায় দুই দশক পর একজন অসহায় মানুষকে নিজের বাড়ি, পরিবার ফিরিয়ে দেওয়ার আনন্দ! এত সব কিছুর পরেও হৃদয়ে আছে ঈষৎ বেদনাও। ডেভিড বলেন, “মাত্র ৫ দিনেই বড্ড আপন হয়ে গিয়েছিলেন। আজ দুপুরেই আমার মাকে রান্নার জন্য কাঠ কেটে দিয়েছিলেন! যখনই খেতে বসতেন, আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, তোমরা খেয়েছ? এমন একজন মানুষ নিজের পরিবার ফিরে পাচ্ছেন, খুব আনন্দ যেমন হচ্ছে; একটু মন খারাপও তো হচ্ছেই!” ডেভিডের সুরে সুর মিলিয়ে বললেন তাঁর মা আর ভাইও। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পিড়াকাটা পুলিশ পোস্টের ইনচার্জ সুদীপ কর, এএসআই‌ নবকুমার মিদ্যা’রা একযোগে বলে উঠলেন, “এরই নাম তো মানবিকতা!” (ছবি- নিজস্ব)

thebengalpost.net
ডেভিড ইমানুয়েলের সঙ্গে রাজেন্দ্র কোল :

thebengalpost.net
Advertisement: