মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৫ জুন: বাবা সাইকেলে করে বাড়িতে বাড়িতে মাছ বিক্রি করেন। মা সামান্য এক গৃহবধূ। মেয়ের জন্য সব বিষয়ের গৃহশিক্ষক-ও দিতে পারেননি! ভরসা বলতে ছিল শুধু বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ এবং স্থানীয় কোচিং সেন্টারের ঐকান্তিক সাহায্য। আর, তার সঙ্গে নিজের আন্তরিক পরিশ্রম ও দাঁতে দাঁত চাপা লড়াই। লক্ষ্য স্থির করে এগিয়েছিল বর্ষা! নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। বাবা-মা’র মুখে একদিন হাসি ফোটাতেই হবে। জঙ্গল অধ্যুষিত পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনীর ডাঙরপাড়া (কর্ণগড় সংলগ্ন)’র দরিদ্র পরিবারের সেই মেয়ে তার প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণের দিকে এগিয়েছে অনেকটাই। সদ্য প্রকাশিত (১০ জুন) উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেছে, ভাদুতলা বিবেকানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ছাত্রী বর্ষা কবি-ই বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপক। পেয়েছে ৪৭২। প্রায় ৯৫ শতাংশ নম্বর। ইংরেজিতে ৯০, ভূগোলে ৯৮, সংস্কৃতে ৯৬ পেয়েছে বর্ষা।
বর্ষার ইচ্ছে ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষিকা হওয়ার। তবে, সুযোগ আর সাধ্য কুলোলে নার্সিং নিয়ে পড়ার ইচ্ছেও আছে। বাধা শুধু আর্থিক অনটন। বর্ষা অকপটে স্বীকার করে, “শুধু নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। অতিমারী পর্বে যেভাবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা সাহায্য করেছেন তা অতুলনীয়। তবে, আমাদের গ্রামের কোচিং সেন্টারের (বিবেকানন্দ রিডিং পয়েন্ট) জগন্নাথ দা সহ অন্যান্যরা পাশে ছিলেন সবসময়। তাঁদের সাহায্য ছাড়া আমার মত পরিবারের মেয়ের পক্ষে এত নম্বর হওয়া সম্ভব ছিলোনা।” বর্ষা বলে, “আপাতত ইংরেজি নিয়েই ভর্তি হতে চাই। শিক্ষিকা হয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে চাই।” বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ড. অমিতেশ চোধুরী বলেন, “আমাদের জঙ্গলমহলের এই বিদ্যালয়ে নিতান্তই নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই পড়াশোনা করে। তাদের লড়াই অনেক কঠিন। অনেক বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে তাদের এগোতে হয়। আমরা শুধু প্রতি মুহূর্তে তাদের পাশে থাকি। আর, সঠিকভাবে গাইড করার চেষ্টা করি।” তিনি যোগ করেন, “আমাদের বিদ্যালয়ের কন্যাশ্রী ক্লাব সারা রাজ্যে প্রশংসিত। এখন আর আমাদের যেতে হয়না, আমাদের কন্যাশ্রী-রাই বাল্যবিবাহ রুখে দেয়। তাই, শুধু বর্ষা নয়; কোয়েল (কোয়েল মন্ডল, ৪৭০, বিজ্ঞান বিভাগ), সহেলী (সহেলী চক্রবর্তী, ৪৭০, বিজ্ঞান বিভাগ)-রাও আমাদের গর্বিত করেছে।” আর, ডাঙরপাড়ার যুবক তথা কোচিং সেন্টারের কর্ণধার জগন্নাথ পাত্র বলেন, “বর্ষার মতো ছাত্র-ছাত্রী আমাদের এই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের গর্ব। দারিদ্র্য উপেক্ষা করে এগিয়েছে বর্ষা। আমরা তাই প্রতিমুহূর্তে ওর পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। ওর স্বপ্ন পূরণ হোক এটাই শুধু চাই!”