দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৩১ আগস্ট: “কী করলে শান্তি পাব? চাকরি থেকে ইস্তফা দিলে? আট বছর জেলায় চাকরি করার পরে আবার জেলাতেই বদলি…কোনও পদোন্নতি ছাড়াই…আর নিতে পারছি না!” গত ১৬ আগস্ট নিজের শরীরে অ্যালকোহল ঢেলে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার আগে এটাই ছিল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিনের প্রাক্তন অ্যাসিস্ট্যান্ট পদমর্যাদার চিকিৎসক ডাঃ অবন্তিকা ভট্টাচার্যের (Dr. Abantika Bhattacharya) ফেসবুক পোস্ট (Facebook)। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে আট বছর কাজ করার পর, বিনা ‘পদোন্নতিতে’ (Without Promotion) বছরখানেক আগে তাঁকে ডায়মন্ড হারবারে বদলি করা হয়েছিল। সেই “বদলি অসন্তোষে” নিজের জীবনই শেষ করে দিলেন বছর ৪০ এর ডাঃ অবন্তিকা। সোমবার এসএসকেএম (SSKM) হাসপাতালে তাঁর দুই সপ্তাহের লড়াই শেষ হল চরম পরিনতির মধ্য দিয়ে! শোকস্তব্ধ রাজ্যের চিকিৎসক মহল।
সূত্রের খবর অনুযায়ী, অবন্তিকার স্বামী মুর্শিদাবাদের নামী স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। আট বছরের মেয়ে ‘অটিজম’ (বিরল মানসিক বিকাশজনিত রোগ) রোগে আক্রান্ত। বাড়ি বেহালাতে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস (MBBS) পাস করার পর, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.ডি (MD) করেন অবন্তিকা। এরপরই, গত প্রায় ৮ বছর ধরে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিনের চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বছরখানেক আগেই (মতান্তরে, মাস ছয়েক আগে) তাঁর বদলি হয় ডায়মন্ডহারবার মেডিক্যাল কলেজে। ‘পদোন্নতি’ হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। অটিজমে আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গেই থাকতে চেয়েছিলেন, তাও হয়নি! চেয়েছিলেন কলকাতার কোনো মেডিক্যাল কলেজে পোস্টিং হোক, তাও হয়নি, পাঠানো হয়েছিল ডায়মণ্ডহারবার মেডিক্যাল কলেজে। সবমিলিয়ে, মানসিক অবসাদ ও হতাশা থেকেই আত্মহত্যা-র পথ বেছে নিয়েছিলেন বলে ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। গত ১৬ অগস্ট বেহালার বাড়িতে অ্যালকহল যুক্ত স্যানিটাইজার গায়ে ঢেলে আগুন লাগিয়ে নেন চিকিৎসক অবন্তিকা ভট্টাচার্য। তার ঠিক আধঘন্টা আগেই ফেসবুকে ক্ষোভ উগরে দেন! লেখেন- “চাকরি ছেড়ে দিলেই কি শান্তি পাবো?” স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ফেসবুক পোস্টের পাশাপাশি স্বাস্থ্য দফতরে ফোন করে চাকরি থেকেও ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন অবন্তিকা। এক্ষেত্রে, স্বাস্থ্য দফতরের বদলি নীতিকে কাঠগড়ায় তুলছেন তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা। দীর্ঘদিন ধরেই স্বাস্থ্য দফতরের বদলি নীতি নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। তার কারণ, বাম আমলে জোন ভিত্তিক একটা বদলি-নীতি ছিল। সকলকেই চাকরি জীবনের শুরুতে জেলা বা গ্রামীণ হাসপাতালে পরিষেবা দেওয়ার নিয়ম ছিল। পাঁচ বছর জেলায় পরিষেবা দেওয়ার পরে তাঁদের বাড়ির কাছে সুবিধামতো পোস্টিং দেওয়া হত। সন্তান বা পারিবারিক সমস্যা থাকলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে যাতে বাড়ির দূরে যেতে না হয়, সেই বিষয়টিও অগ্রাধিকার পেত। কিন্তু, এখন কার্যত কোনও বদলি নীতি মানা হচ্ছে না বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ! আত্মহত্যার মতো গর্হিত সিদ্ধান্তকে সমর্থন না করলেও, তরুণী চিকিৎসক অবন্তিকা’র এই পরিণতির জন্য স্বাস্থ্য দপ্তরের নীতিকেই কাঠগড়ায় তুলছেন সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বদলি অসন্তোষের কারণেই রাজ্যের ৫ এসএসকে শিক্ষিকা বিষ পান করেছিলেন! তাঁদের মধ্যে কয়েকজন এখনও চিকিৎসাধীন। ফের, এক চিকিৎসকের আত্মহত্যা-র জন্যও দায়ী সেই বদলি নীতি! এ প্রসঙ্গে চিকিৎসক নেতা উৎপল দত্ত সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, “অবন্তিকার পরিবারের পাশে আমরা আছি। চিকিৎসক ও শিক্ষক চিকিৎসকরা বদলির সমস্যায় ভুগছেন। তাঁদের মানসিক অবস্থা কোন জায়গায় পৌঁছচ্ছে, তার একটা খারাপ উদাহরণ আমরা দেখলাম। বিগত ১০ বছর ধরে বদলির নীতি নিয়ে ভুগছেন চিকিৎসকরা। বদলিতে স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। বেছে বেছে কয়েকজন চিকিৎসকের ক্ষেত্রে বাড়ি থেকে বহু দূরে বা অপছন্দের জায়গায় বদলি করা হচ্ছে, তবে সকলের ক্ষেত্রে নয়! অবন্তিকার বাচ্চাটি অসুস্থ। অবন্তিকা হাসিখুশি মেয়ে ছিলেন, তা সত্ত্বেও এই ঘটনায় আমরা শোকস্তব্ধ।”